হাজারো বছরের সাক্ষী পার্থেনন

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বের অনেক শহর তাদের প্রাচীন ধর্ম ও অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। গ্রীসের এথেন্স শহরটিও সাক্ষী হয়ে আছে এমন অনেক ইতিহাসের। গ্রীক স্থাপত্যশিল্প পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। ইউরোপজুড়ে গ্রীসের এমন অনেক স্থাপনা ছড়িয়ে আছে যা প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করছে। এমনই এক স্থাপনার নাম ‘পার্থেনন।’

এই স্থাপনাটি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিলো। বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহের প্রভাবে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এখনো নিজের মহিমা বজায় রেখে টিকে আছে স্থাপনাটি।

খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে ইতিহাসের বিখ্যাত ম্যারাথন যুদ্ধটি হয়। সেই সময়ে প্রথম গ্রীসের এথেন্সে একটি মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করে গ্রীকবাসীরা। অ্যাক্রোপলিসের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।

ইতিহাসে বলা হয়েছে যে, নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ সালে পার্সিয়ানরা অ্যাক্রোপলিস আক্রমণ করে এবং শহরটির অনেক স্থাপনা ভেঙে ফেলে। ধারণা করা হয় যে এই স্থাপনাটিও তখনই ভাঙ্গা হয়। এরপর পার্থেননের কাজ দীর্ঘ ৩৩ বছরের জন্য আটকে রাখা হয়। তবে তার কারণ কি ছিলো সেটা এখনও সবার কাছে অজানাই রয়ে গেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪৭ সালে গ্রীকরা পার্সিয়ানদের বিপক্ষে জয়লাভ করে। সেই যুদ্ধে গ্রীকদের হয়ে অসামান্য অবদান রাখেন সেনাপতি পেরিক্লেস। এরপর মন্দিরটির নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করা হয়।

পার্থেনন যখন নির্মাণ করা হচ্ছিলো সে সময়ে রাষ্ট্র নামক কিছু ছিলোনা। তবে নগর রাষ্ট্র ছিলো। গ্রীসে প্রায় ১৫০-৩০০ নগর রাষ্ট্র মিলে একটি জোট গড়ে তোলা হয়। সেই জোটের নাম দেয়া হয় ‘ডেলিয়ান লিগ’।

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে এই সংঘটির কেন্দ্র হিসেবে এথেন্সকে নির্বাচন করা হয়। শিক্ষা,সংস্কৃতি,বিজ্ঞান এবং শিল্পচর্চার সবদিক থেকে এথেন্স সেই সময়ে অনন্য হয়ে ওঠে। তাই এই সময়কালকে এথেন্সের স্বর্ণযুগ বলা হয়।

বিখ্যাত যোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ পেরিক্লেস তখন এথেন্সের সেনাপতি ছিলেন। ৪৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি এথেন্সের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করেন। পার্থেনন তার সেই প্রকল্পরই একটি অংশ। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩২-৩১ সালের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। পার্থেননের সকল ভাস্কর্যের নকশা এবং পরিকল্পনা বিখ্যাত গ্রীক ভাস্কর ফিডিয়াস বাস্তবায়ন করেন। পুরো স্থাপনার নকশা করেন স্থপতি ইকটিনোস এবং ক্যালিক্রেটস।

ইউনিভার্সিটি অব অরেগনের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক জেফরি হারউইট বলেন, ‘পেরিক্লেসের অধীনে এথেন্স গ্রিসের অন্য শহরগুলোর থেকেও উন্নত এবং আধুনিক হয়েছিলো।’

পার্থেননের নামকরণ

পার্থেনন একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ অবিবাহিত/কুমারী নারীর ঘর। বলা হয় যে, গ্রীক দেবী এথেনার সম্মানে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থাপনাটির প্রাথমিক পর্যায়ে পার্থেনন ছিল পুরো স্থাপনার মধ্যে শুধুমাত্র একটি কক্ষের নাম। অনেকে মনে করেন সেই কক্ষে দেবী এথেনার মূর্তি ছিল।

নির্মাণের পরবর্তী সময়ে পুরো স্থাপনাটি পার্থেনন নামে পরিচিতি পায়।

গ্রীসের লোকজন দেবী এথেনাকে তাদের রক্ষক মনে করতো। তাই অনেকের ধারণা মতে দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্যই তার জন্য মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে বলা আছে অন্য কথা । পার্থেননের গঠন আর নির্মাণশৈলির কারণে একে মন্দির বলা হলেও আসলে পার্থেনন মন্দির ছিলনা। শুধুমাত্র একটি কক্ষে দেবী এথেনার মূর্তি ছিল।

প্রাচীন ইতিহাসের জনক গ্রীক দার্শনিক হেরোডোটাস পার্থেনন সম্পর্কে লিখেছিলেন। তার লেখাসহ আরো বেশ কিছু লেখা থেকে জানা যায় যে, পার্থেননে নির্মিত দেবী এথেনার মূর্তি কখনো পূজা করার জন্য ব্যবহার করা হতো না। মূর্তির ওখানে কোনো পূজারী বা ধর্মযাজকও ছিলোনা।

সাধারণত সেটি গ্রীকদের নগর রাষ্ট্রগুলির একটি দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিশ্চিতভাবে এটা জানা যায় যে, পার্থেনন নির্মাণের একশত বছরের মধ্যেই এটি মন্দিরে রূপান্তরিত হয়।

তার লেখা থেকে আরও জানা যায় যে, পার্থেননের নিচে মহামূল্যবান গুপ্তধন লুকানো আছে।

পার্থেননের গঠনপ্রকৃতি

পার্থেননকে মন্দির বলার প্রধান কারণ হল এর গঠনপ্রকৃতি। স্থাপনাটি অষ্টস্তম্ভ বিশিষ্ট ডোরিক আকারে নির্মিত। প্রাচীন গ্রীসের আরো অনেক মন্দিরের সঙ্গে এর নির্মাণশৈলীর মিল রয়েছে। এর সামনে পিছনে দুই প্রান্তে ৮টি করে স্তম্ভ রয়েছে এবং দুই পাশে রয়েছে ১৭ টি করে। এটির মোট স্তম্ভ সংখ্যা ৬৯ টি।

এর ভিতরের কক্ষগুলি মূলত দুটি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত যাদের ‘সেলা ‘ বলা হয়। কম্পার্টমেন্ট দুটির নাম হলো, ‘সেকোস’ এবং ‘নাওস’। ইমব্রাইস নামক বিশাল আকারের মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত ছাদের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকালে প্রাচীন গ্রীসের পদচারণায় মুখর পার্থেননের অতীতের স্মৃতিচারণ করা যায়।

১৩.৭ মিটার উচ্চতার এই স্থাপনার দিকে তাকালেই অনুভব করা যায় যে এর অতীত কতোটা গৌরবময় ছিল। পার্থেননের বাহ্যিক গঠনে অপরাপর গ্রীক মন্দিরের সাথে মিল থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই স্থাপনাটি অনন্য। পার্থেনন এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে থাকা একমাত্র নিখুঁত প্রাচীন গ্রীক ডরিক মন্দির।

পার্থেনন মূলত নির্মিত হয়েছিল গ্রীক দেবী এথেনার সম্মানে। তাই এই স্থাপনার মূল আকর্ষণ ছিল এথেনার সুবিশাল একটি ‘ক্রাইসেলেফ্যান্টাইন’ ভাস্কর্য। স্বর্ণ এবং আইভরি দ্বারা নির্মিত মূর্তি বা ভাস্কর্যকে ক্রাইসেলেফ্যান্টাইন বলা হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্যমতে গ্রীক ভাস্কর ফিডিয়াসের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এটি।

তবে অমূল্য এই ভাস্কর্যটি দেখার সুযোগ সকলের হয়নি। ২৯৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সের স্বৈরাচারী শাসক ল্যাচার্স তার সৈন্যদের ভরণপোষণের জন্য এই অসাধারন ভাস্কর্যটির গায়ের পুরু স্বর্ণের স্তর তুলে ফেলেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ভাস্কর্যটি পরবর্তীতে মেরামত করা হয়। আনুমানিক ৫ম খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে রোমানরা পার্থেনন থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়। ঐতিহাসিকদের মতে, অ্যাথেনার মূর্তিটি রোমানদের সময়েও যথেষ্ট সম্মান পেতো।

তারপর থেকে দেবী এথেনার ভাস্কর্যটির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে একটি বিতর্কিত সূত্রমতে, ১০০০ খ্রিষ্টাব্দেও এথেনার ভাস্কর্যটির কনস্টান্টিনোপলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এথেনার ভাস্কর্য ছাড়াও আরো অনেক সুদৃশ্য সব ভাস্কর্য আর মূর্তি দিয়ে পার্থেনন সাজানো হয়েছিল।

সব ভাস্কর্যগুলি টিকে থাকতে পারেনি। সময়ের প্রবাহে টিকে থাকা ভাস্কর্যগুলির অধিকাংশের স্থান হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস জাদুঘরে।

পার্থেননের অন্তিম পরিণতি

সেনাপতি পেরিক্লেস খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হেরুলি দস্যুরা দ্বিতীয় শতকে এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস আক্রমণ করে এবং এর ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে। তবে এর চূড়ান্ত ক্ষতিটা হয় মূলত আগুন লেগে। ভয়াবহ সে আগুনেই ধসে পড়ে পার্থেননের ছাদ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভেতরের ভাস্কর্য এবং কক্ষগুলির।

গ্রীক দেবীর মন্দির হিসেবে পার্থেনন পরিচিত ছিল প্রায় এক হাজার বছর। ৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস একটি রাজকীয় ডিক্রি জারির মাধ্যমে সমগ্র গ্রীসে সকল প্রকার পেগান মন্দির বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা করেন। তখন থেকে পার্থেননে দেবী এথেনার উপাসনা করা বন্ধ হয়ে যায় যা আর কখনও চালু হয়নি।

দেবী এথেনার উপাসনা বন্ধ করার পর থেকে পার্থেননের অবস্থা বদলে যায়। প্রথমে সেটিকে একটি খ্রিষ্টান চার্চে রূপান্তর করা হয়। শুধু তাই নয় পরিবর্তন করা হয় তার সাজসজ্জাও। মন্দিরটির মূল প্রবেশপথ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আনা হয়। একটি টাওয়ার নির্মাণ করা হয়।

১৫ শতকের শেষ দিকে অটোমানরা অ্যাক্রোপলিস আক্রমণ করে। তারা তখন পার্থেননের সেই নির্মিত চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তর করে। প্রবেশপথে থাকা সেই টাওয়ার টিকে আরো উঁচু করে মিনার তৈরি করা হয়। তবে এতো সবকিছুর মধ্যেও মন্দিরের মূল গঠন অপরিবর্তিত ছিল।

পার্থেননের সবচেয়ে বড় ক্ষতিসাধন হয় তুর্কি যুদ্ধের সময়। এই যুদ্ধে পার্থেননকে গানপাউডার রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে, যুদ্ধের একপর্যায়ে পার্থেননে একদিন বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে তিন শতাধিক অটোমান সৈন্য নিহত হয়। পার্থেননের প্রাথমিক স্থাপনার অধিকাংশই সেই বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। আরো ধ্বংস হয় মসজিদের মিনার,গীর্জার অঙ্গসজ্জা এবং আদি এথেনার মন্দিরের বহু অমূল্য নিদর্শন।

১৮৩২ সালে গ্রীস স্বাধীন হলে পুরো গ্রীসজুড়ে নির্মিত সকল অটোমান নিদর্শন ধ্বংস করা হয়। পরবর্তীতে এই স্থানটিকে পর্যটকদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।

২০১৫ সালে একদল প্রকৌশলী পার্থেননের কাঠামোগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। তারা জানান, আড়াই হাজার বছর আগের স্থপতিরা এর কাঠামোকে ভূমিকম্প সহনীয় করেই তৈরি করেছিলেন। যার কারণে অ্যাক্রোপলিস ও পার্থেননের কাঠামো এখনো এথেন্সের বুকে দাঁড়িয়ে আছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০