গাজী-চম্পার বিয়ের গল্প থেকে শুরু শেরপুরের কেল্লাপোশী মেলা

ষ্টাফ রিপোর্টারঃ জনশ্রুতিতে জানা যায়, রাজামুকুটের সঙ্গে যুদ্ধ করে তার মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করেন গাজী মিয়া। এ দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিনদিনের আনন্দ উৎসব পালন করে সে সময়। সেই ধারা বজায় রেখে এখনও প্রতি বছর আয়োজন করা হয় কেল্লাপোশীর মেলা।

বগুড়ার শেরপুরের কেল্লাপোশী নাম স্থানে এই মেলা হয়ে থাকে। তিথি অনুযায়ি প্রতি বছর জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার থেকে মেলা শুরু হয়। চলে তিনদিন। তবে এবার রমজান ও করোনার কারণে দীর্ঘ ৫ বছর বন্ধের পর বগুড়ার শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা। মেলা আজ থেকে শুরু হলেও আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকে গ্রামের মানুষদের মাঝে আমেজ দেখা দেয়। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘জামাইবরণ’ মেলা নামেও পরিচিত।

কেল্লাপোশী বাজার এলাকার মকবুল হোসেন জানান, তিথী অনুয়ায়ি গত ৩ বছর ধরে রমজান মাসে মেলার দিনতারিখ পড়ে। এ জন্য মেলার আয়োজন বন্ধ ছিল। এরপর করোনার কারণে ২ বছর বন্ধ রাখতে হয়। এবার জাঁকজমকভাবে মেলাটি শুরু হয়েছে। এবং মেলার পুরাতন ঐতিহ্য ফিরে আসছে।

বাদশা নামে আরেক গ্রামবাসী জানান, মেলার অন্তত সপ্তাহখানেক আগ থেকেই গ্রামের লোকজন নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মেলা উপলক্ষে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনেন। বিশেষ করে নতুন জামাই-বউকে নিয়ে সবাই ভিন্ন আনন্দে মেতে ওঠেন। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে জামাই বাবুকে মোটা অঙ্কের সেলামীও দেওয়া হয়।

স্থানীয়দের কাছে আরও জানা যায়, মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাক-ঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা শেষ করে।
মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এ মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফলমূল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুঠির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা।

গ্রামের জামাইরা শ্বশুর বাড়ির সেলামী ও নিজের টাকা দিয়ে মেলা বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন, মাছ, খাসী-মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ফিরে দেখেন। তাদের সার্কাস, নাগোরদেলা, হুন্ডা, যাদু, পতুল নাচ খেলা দেখিয়ে দিনব্যাপি আনন্দ শেষে ছাতা, ছোটদের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরী খেলনা সামগ্রী নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরেন। এ ছাড়াও মেলায় রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন পাওয়া যায়।

উপজেলার বয়োজ্যৈষ্ঠদের কাছে জানা যায়, কথিত ১৫৫৬ সাল থেকে এ মেলা হয়ে আসছে। জনশ্রুতি রয়েছে, বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ওরশজাত এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ওরশজাত পুত্র গাজী মিয়া আর দত্তক পুত্রের নাম কালু গাজী মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। একপর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দি করেন।

পরিপ্রেক্ষিতে গাজী মিয়া মুকুট রাজার কাছে থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। ওই রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন।

আর তিথি অনুযায়ি ওই দিনটি ছিল জ্যেষ্ঠের দ্বিতীয় রোববার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপি আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়।

ঐতিহ্যবাহী এ মেলার আইন-শৃংখলা রক্ষার বিষয়ে শেরপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ এই মেলার অনুমতি দেয়া হলেও মেলায় কোনো সার্কাস, যাত্রা, জুয়া বা বিচিত্রা চলবে না। যেহেতু মেলাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ঘটে। তাই আইনশৃখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১