এবারও কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির শঙ্কা

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ এবারও কোরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির শঙ্কা রয়েছে। ট্যানারি খাতের ব্যবসায়ীরা এবারও কোরবানি ঈদ সামনে রেখে পানির দরে চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারের বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতরে ইতোমধ্যে নানা ধরনের সঙ্কটের কথা তুলে ধরে চিঠি দিচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমানো। তবে সরকার কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও কোরবানির চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রেখে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ট্যানারি খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ মূলত দেশের অসহায়-গরিব ও মা-বাবাহীন এতিমদের হক বা অধিকার। ওই কারণে কোরবানি দাতারা বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা এবং এতিমখানার ছাত্রদের হাতে বিনামূল্যেই গবাদিপশুর চামড়া দিয়ে থাকে। কিন্তু ওই চামড়ায় ভাগ বসায় ট্যানারি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে পানির দামে মাঠ থেকে কোরবানির চামড়া কিনে নেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে চামড়া খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাজার সম্প্রসারণ, ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, পরিবেশগত মান বজায় রাখা এবং ফিনিশড লেদার উৎপাদনে সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নির্ধারণের ওপর জোর দিচ্ছে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। ওই দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ইতোমধ্যে চামড়া খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে। ওসব বৈঠকে ব্যবসায়ীরা চামড়া শিল্প খাতে বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়ার সঠিক দাম নির্ধারণের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। যে কারণে এবারও কোরবানীর পশুর চামড়ার দর নিয়ে দেশে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই চামড়া খাতে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের চামড়া খাতের সুনাম নষ্ট হয়েছে। ফলে চামড়া রফতানি বাড়লেও বিদেশী (বায়ার) ক্রেতারা আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখার তাগিদ দিয়েছে। বিদেশী ক্রেতারাও দেশে কাঁচা চামড়া সঠিক দাম নিশ্চিত করার কথা বলেছে। চামড়া খাতের উন্নয়ন নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে বৈঠক করা হয় সেখানেও বিদেশী ক্রেতারা এ বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিবেশগত মান বজায় রাখতে শতভাগ কমপ্লায়েন্স কারখানা গড়ে তোলারও সুপারিশ করা হয়েছে। কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণে ৬ জুলাই জরুরি বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে স্টেকহোল্ডারদের উপস্থিতিতে কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয়া হবে। তবে এবারও প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যেসব ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারা কাঁচা চামড়া রফতানি করতে চায় তাদের আগেভাগে চিঠি দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে।

সূত্র জানায়, ট্যানারি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এবারও পানির দরে চামড়া হাতিয়ে নিতে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে চিঠি চালাচালি করছে। গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে সারাদেশে কমদামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও চামড়ার নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি। সম্প্রি বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস এ- ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএল-এলএফইএ) পরিবেশ ছাড়পত্র নবায়ন সংক্রান্ত একটি পত্র বিভিন্ন দফতর অধিদফতর এবং মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ওই চিঠিতে বিভিন্ন সঙ্কটের কথা তুলে ধরে জানানো হয়, কোরবানি ঈদ সমাগত। কিন্তু বন্ড লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখার কারণে কারখানাসমূহ প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আমদানি করতে পারছে না। ফলে কোরবানির সময় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া ব্যবস্থাপনায় প্রচ- বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে। বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। আর কোরবানির মৌসুমে ওই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে। তার মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।

সূত্র আরো জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। তাছাড়া ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। সারাদেশে খাসির চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাছাড়া প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোরবানির চামড়ার বাজারে সরকার নির্ধারিত ওই দাম কার্যকর হয়নি।

এদিকে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণের পক্ষে। এবারও দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। কোরবানি দাতারা যাতে না ঠকেন সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে। দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজার দরের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হবে। বাংলাদেশ ট্রেড এ- ট্যারিফ কমিশন ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে। চামড়ার বাজারে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে। যদিও চামড়ার বাজারের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে বিভিন্ন পর্যায়ের চামড়া ব্যবসায়ীরা সংগঠনের প্যাডে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিচ্ছে। সেসব চিঠিতে তারা বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চামড়ার কেমিক্যালের দাম বাড়া, পুরো ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আভাস, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ও গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, দেশে বিভিন্ন দফায় গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানি ও লবণের দাম বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের সঙ্কটের কথা বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের নীতিগত সহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি সহজলভ্য করার দাবি রয়েছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ