শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশেই কমছে রিজার্ভ

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে এখন বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে। বিশেষ করে গত ১২ জুলাই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর থেকে সেই আলোচনার আগুনে ঘি পড়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাহলে কি বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কা হতে চলেছে?

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলট-পালট হয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশের রিজার্ভই এখন কমছে। বিশ্বে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকে চীনে। সেই চীনের রিজার্ভ গত সাত মাসে ২০০ বিলিয়ন ডলার কমে ৩ হাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ হাজার ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। দ্বিতীয় স্থানে জাপানের রিজার্ভ ১০০ বিলিয়ন ডলার কমে ১ হাজার ৪০০ বিলিয়ন থেকে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তৃতীয় স্থানের সুইজারল্যান্ডের রিজার্ভ ৯৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৮৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

আর পাশের দেশ ভারতের রিজার্ভ নেমে এসেছে ৫৭২ বিলিয়ন ডলারে। যা গত ২০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত ১৫ জুলাই শেষ হওয়া সপ্তাহে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে ৫৭২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেও ভারতের রিজার্ভ ৬০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান করছিল।

অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলোর মতো রিজার্ভ নিয়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের আর কোনো তুলনাই চলে না। বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নামার পরও পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই গুণের বেশি। পাকিস্তানের রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটে থাকা শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের তথ্য ঘেঁটে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।

আর্থিক বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা, আমদানি ব্যয় মেটানো, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রানীতি জোরদারকরণ, বাজারে আস্থা ধরে রাখাসহ বাজেট বাস্তবায়ন, বৃহৎ প্রকল্পে অর্থের জোগান, বৈদেশিক দায় পরিশোধ নিশ্চিত করতে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্পদের মজুত হিসেবে ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রাখে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, যেকোনো দেশেরই নিজস্ব মুদ্রার বাইরে বিদেশি মুদ্রায় তা রাখা উচিত। নিয়মটি সারা বিশ্ব মেনে চলে।

সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত হিসেবে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ মার্কিন ডলারকে বেছে নেয়। তবে দেশভেদে মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো, চীনা ইউয়ান ও জাপানি ইয়েনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখা হয়। অবশ্য বিদেশি মুদ্রার পাশাপাশি ব্যাংক নোট, বন্ড, আমানত, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য সরকারি সিকিউরিটিজের মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রাখা যেতে পারে।

বিদেশি মুদ্রা মজুতে গত বছরের জুলাই মাসে রাশিয়াকে পেছনে ফেলে চতুর্থ স্থানে উঠে আসে ভারত। প্রথমবারের মতো দেশটির রিজার্ভ ৬০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে টপকায় ভারত। তবে, ভারতের রিজার্ভ কমার পর দুই দেশের রিজার্ভ এখন কাছাকাছি। জুলাইয়ের প্রথম দিকে রাশিয়ার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো।

ষষ্ঠ থেকে দশম স্থানে থাকা দেশগুলোর মজুতের পরিমাণ হচ্ছে যথাক্রমে তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর ডলার। তাইওয়ানের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৫৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

এভাবে বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় ছোট-বড় সব দেশের রিজার্ভই এখন কমছে। বিদেশী মুদ্রার মজুতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পেছনেই রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ৪০তম। গত সপ্তাহের শেষ দিন বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারাবাহিকভাবে বাজারে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি।

সেই ধারাবাহিকতায় ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২১ দিনে (১ থেকে ২১ জুলাই) প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ডলারের বিপরীতে রুপির পতন ঠেকাতে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাজারে ডলার ছাড়ছে। আর এর জেরেই রিজার্ভ এতটা কমেছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘অযথাই ভয় পাচ্ছে দেশের মানুষ। অনেকে আবার ইচ্ছে করে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমি মনে করি বর্তমানের বাংলাদেশে যে রিজার্ভ আছে তা যথেষ্ট ভালো; সন্তোষজনক। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার আগ পর্যন্ত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।

‘আর আমার বিশ্বাস, সেটা এই দেশে কখনই হবে না। সরকার ব্যয় সংকোচনের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদেক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। আমার বিশ্বাস, এ সব কিছুর ইতিবাচক ফল খুব শিগিগিরই পাওয়া যাবে। সংকট কেটে যাবে।

মাত্র ১২ কোটি ডলার থেকে শুরু

স্বাধীনতার পর প্রায় এক দশক বাংলাদেশের রিজার্ভের কোনো তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নেই। প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায়, ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের, তখন রিজার্ভ ছিল মাত্র ১২ কোটি ১০লাখ ডলার। পাঁচবছর পর ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছর শেষে সেই রিজার্ভ বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরশেষে রিজার্ভ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ‘ঘর’ অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে উঠে।

১৯৯২-৯৩ অর্থবছর শেষেই রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর শেষে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে তা কমে ২ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও কমে ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এরপর ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের মধ্যে উঠানামা করে।

২০০০-০১ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। ওই অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে তা ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। এরপর অবশ্য কখনই রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আসেনি। ২০০১-০২ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ৫ বিলিয়ন ডলার অত্রিক্রম করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বেড়েই চলেছে অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।

২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। পরের বছর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৬ সালের জুনে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ জুন সেই রিজার্ভ আরও বেড়ে ৩৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ৪০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়ায় ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর। এভাবে বাড়তে বাড়তেই গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ