বগুড়ায় হাতে তৈরী আলু শুটকি দেশের গন্ডি পেরিয়ে এবার ভারতে

সাখাওয়াত হোসেন জুম্মা ঃ টিন শিটে বা এ্যালমুনিয়ামের তৈরি বড় পাতিলের মুখে এক ধরনের ছোট যন্ত্র বসিয়ে তার ওপর আলু ধরে হাত দিয়ে একজন চাপছে, আর সঙ্গে সঙ্গে পাতলা ফালি-ফালি হয়ে যাচ্ছে আলুগুলো। ঘরের বাইরে বারান্দার পাশেই চুলার ওপর বড় পাতিল বসিয়ে গরম পানিতে কাটা ফালিগুলো সেদ্ধ করার কাজ করছেন আরেকজন।

উঠানে রোদে শুকানোর জন্য ছড়িয়ে দেয়াসহ নানা কাজে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে প্রার্থনা রানী মহন্ত। আর তাকে সহযোগীতা করছে স্বামী নয়ন মহন্ত। এদের বাড়ী বগুড়ার জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার কল্যাণনগর হিন্দুপাড়ায়।

তবে এসব কাজে প্রার্থনা রানী মহন্তের মত, মুক্তি রানী, প্রমিলা, সাধনাসহ একাধিক গৃহিনীও ব্যস্ত রয়েছে। গরমে গায়ের ঘাম ঝড়ে পড়লেও রঙিন স্বপ্ন বুঁকে নিয়ে ও ধ্যান-জ্ঞানে পেশায় পরিণত হয়েছে আলুর পাপড় ও শুটকি তৈরী করা। তবে শুধু কল্যান নগরই নয়, আর এ পেশা একমাত্র উপার্জনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে উপজেলার হাটধুমা ও চাকলমা গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার।

তিনযুগের অধিক সময় ধরে এসব গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আলুর শুঁটকি ও পাঁপড়ে তাদের স্বপ্ন বুনছেন। তাদের হাতের ছোঁয়া ও পরিশ্রমের ফসল আলু শুঁটকি স্থানীয় অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। তবে শুধু তাই নয়, এ আলু শুঁটকি এবার দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে।

সরেজমিনে নন্দীগ্রাম উপজেলার কল্যাণনগর গ্রামের হিন্দুপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মুক্তি রানী মহন্ত নামের একজন গৃহিনী তার বাড়ির বাইরে চা দোকানের পাশে ফাঁকা জায়গায় আলু কাটার কাজ করছেন। তার মতো এ রকম অনেক পরিবারের নারী-পুরুষ আলুর চিপস তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কেউ আলু কাটছেন, কেউ আলু সেদ্ধ করছেন, আবার কেউ কাটা আলুর চিপসগুলো কাপড় ও জালের উপরে রেখে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ফাঁকা মাঠ, বাড়ির ছাদ-উঠান, রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গা এবং পুকুরের পাড়। আবার কেউ কেউ আলু শুঁটকি করার পর গরম তেলে ভেঁজে পাঁপড় তৈরির কাজ সম্পন্ন করছেন।

এসব আলুর শুটকি বা পাঁপড় তৈরীতে স্টিক বা ক্যাটিনাল আলুর ব্যবহারই বেশী হয়। স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে প্রতি মণ ৪৩০টাকা থেকে ৪৮০টাকায় সংগ্রহ করা হয়। এক মণ আলু শুকিয়ে শুঁটকি অবস্থায় ওজনে দাড়ায় ৯/১০ কেজি। বিভিন্ন জেলার পাইকাররা গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিনছেন শুঁটকি আলু, যা প্রতি কেজি ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকা দরে বিক্রি হয় বলে এসব কাজে জড়িত শ্রমিক পুরুষ সদস্যরা জানায়।

নয়ন মহন্তের সাথে আলাপচারিতাকালে তিনি জানান, কৃষি কাজের পাশাপাশি প্রায় ২০ বছর বাড়িতেই চানাচুর ও চিঁড়াসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে নন্দীগ্রাম সদর, ওমরপুরসহ বিভিন্ন হাটে-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তিনি। এ বছর চার বিঘা জমিতে স্টিক আলু চাষ করেছেন। সেই আলু দিয়েই শুঁটকি ও পাঁপড় তৈরি করছেন।

তবে খরচ বেশি হওয়ায় কিছুটা বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে, হাটে-বাজারে ভাজা পাঁপড় ২’শ টাকা কেজি দরে খুচরা বিক্রি করেন। দাম বেশির কারণে ক্রেতার সংখ্যা বেশ কম, দিনে ৫-৬ কেজির বেশী বিক্রি করা কঠিন। এসব পাঁপড়ে প্রতি কেজিতে ৩০টাকা থেকে ৪০টাকা লাভ হয় বলে তিনি জানান।

একই সঙ্গে আলুর শুঁটকি তৈরীর আরেক কারিগর মুক্তি রানী মহন্তের কথা বললে তিনি বলেন, ‘ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, আমাদের গ্রামের তৈরি আলু শুঁটকি দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়, তবে এখন ভারতেও যাচ্ছে। আর এজন্য পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মিলে আলু তোলার মৌসুমে আলুর এ মুখরোচক পণ্য তৈরি করে।

এসব কাজে নিয়োজিত অন্যান্য কারিগররা বলেন, পরিশ্রম একটু বেশি হলেও অনেকে দ্বিগুন লাভের আশায় বাড়িতেই আলু শুঁটকি করে মজুদ রাখেন। অন্যদিকে স্বল্প পুঁজি নিয়ে কেউ কেউ বাড়িতে আলু শুঁটকি করার পর তেলে ভাজা পাঁপড় তৈরি করেন এবং হাটে-বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। তেলের দাম বেশি, একারণে ভাজা পাঁপড়ের দামটাও বেশি।

তাছাড়া সরকারিভাবে ঋণ সহায়তা পেলে আলু দ্বারা রসনাবিলাস বা মুখরোচক খাদ্যের এই পণ্য তৈরিতে গ্রামেই গড়ে উঠতে পারে বড় ধরণের কর্মসংস্থান বলে দাবী করছেন এ কাজে জড়িত নারী-পুরুষেরা।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ