প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়?

প্রফুল্ল চাকী (১০ ডিসেম্বর, ১৮৮৮ – ২ মে, ১৯০৮) আত্মহত্যা করেন নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়?

১৯০৮ সালে মোকামা স্টেশনে প্রফুল্ল চাকীকে পুলিশ ঘিরে ফেলায়, তিনি আর কোনও উপায় না দেখে আত্মহত্যা করেন৷ প্রচলিত ইতিহাস তথ্য৷ কিন্তু পুলিশ রেকর্ডই বলছে অন্য কথা৷

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে সকল তথ্য ও সংবাদ পাওয়া গেছে তার বিশ্লেষণে প্রফুল্ল চাকীর আত্মহত্যার তত্ত্বটি সমর্থিত হয় না, বরং তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল এটাই নির্দেশিত হয়৷

এখানে মনে করা দরকার, কিংসফোর্ডকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর ভূমিকা কী ছিল? বোমাবর্ষণের পর তাঁরা কেমন করে, কোন পথে পালালেন? ক্ষুদিরাম বসু কীভাবে ধরা পড়লেন? প্রফুল্ল চাকী’র কীভাবে মৃত্যু হল? এসব প্রশ্নের ঠিক-ঠাক উত্তর জানা নেই৷ বিভিন্ন লেখক ও সমসাময়িক পত্রিকার প্রতিবেদনে অসঙ্গতি প্রচুর, অথচ প্রত্যেকেই বিস্ময়কর ভাবে নিজের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করতে থাকেন। যদিও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনের সময়ে অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে একদল কিশোর-তরুণ বিপ্লববাদের মন্ত্র গ্রহণ করেন৷ ১৯০৬ সালে কলকাতার বিপ্লবী নেতা বারীন ঘোষ প্রফুল্ল চাকীকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। যেখানে প্রফুল্ল চাকী যুগান্তর দলে যোগ দেন। তাঁর প্রথম দায়িত্ব ছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর জোসেফ ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যা করা। কিন্তু এই পরিকল্পনা সফল হয়নি। ইতিমধ্যে কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য বাংলার বিপ্লবী দল পরিকল্পনা করে। তখন কিংসফোর্ড কলকাতা প্রেসিডেন্সির বিচারক। কিংসফোর্ডের কলকাতায় অবস্থান কালে (আগস্ট ১৯০৪ থেকে মার্চ ১৯০৮) তাঁর হাতে অনেক বিপ্লবীর বিচার ও শাস্তি হয়৷ ‘যুগান্তর’, ‘সন্ধ্যা’, ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকাগুলির বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগের বিচারক তিনিই ছিলেন এবং শাস্তি প্রদানও করেছিলেন৷ প্রতিবাদী কিশোর সুশীল সেনকে প্রকাশ্যে বেত মারার হুকুমও এই বিচারকই দেন৷

প্রথমে হেমচন্দ্র দাস কানুনগোকে দিয়ে বোমা তৈরি করানো হয়। জানুয়ারি ১৯০৮ নাগাদ একটি বারোশো পাতার ‘বই বোমা’, যা খোলামাত্রই বিস্ফোরণ ঘটাবে – তা কিংসফোর্ডের গার্ডেনরিচের ঠিকানায় পার্সেল করে পাঠানো হয়। কিন্তু কিংসফোর্ড বইটি না খুলে আলমারিতে রেখে দেন৷ ফলে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। (এই ‘বই বোমা’ আজও ‘কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামে’ নিস্ক্রিয় অবস্থায় রাখা আছ) যদিও ব্রিটিশ গোয়েন্দার খবরে ভয় পেয়ে ইংরেজ সরকার সম্ভাব্য আক্রমণ এড়াতে কিংসফোর্ড’কে বিহারের
মজফ্ফরপুরের জেলা ও সেশন জজ ডি.এইচ. বদলি করে পাঠানো হয়।

এরপর, বারীন ঘোষ ও উপেন বন্দ্যোপাধ্যায় স্থির করলেন মজফ্ফরপুরেই কিংসফোর্ড-নিধনের কাজ শেষ করবেন। সেইমতো তাঁরা প্রস্তুতি নিলেন এবং নিয়োগ করলেন প্রফুল্ল চাকী’কে। হেমচন্দ্র দাস কানুনগোর সুপারিশে ক্ষুদিরাম বসু’কে প্রফুল্ল চাকী’র সঙ্গী হিসেবে দেওয়া হয়।

৩০ এপ্রিল, ১৯০৮, বৃহস্পতিবার৷ অমাবস্যা৷ বিপ্লবীদের কাছে খবর ছিল, ইউরোপিয়ান ক্লাবে রোজই সন্ধ্যের পর ফিটন গাড়িতে চেপে তাস খেলতে যেতেন কিংসফোর্ড, ফিরতেন সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ৷ ফিটন গাড়িটিকে ক্লাবের দিক থেকে আসতে দেখে তাঁরা বোমা ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হলেন, কেননা তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন এই গাড়িটিই কিংসফোর্ডের এবং সেখানে তিনিই রয়েছেন৷ গাড়িটি কাছাকাছি আসতেই বোমা ছোড়া হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তা গাড়িটিকে চুরমার করে দেয়৷ কোচম্যান ও ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা সহিস আহত হল এবং ভিতরে বসে থাকা দুই মহিলা মারাত্মকভাবে জখম হলেন৷ এই মহিলা দু’জন হলেন স্থানীয় উকিল প্রিঙ্গল কেনেডি সাহেবের স্ত্রী ও কন্যা৷ তাঁরা ক্লাব থেকে ফিরছিলেন, তাঁদের গাড়িটি কিংসফোর্ডের গাড়িটির মতোই দেখতে৷ কেনেডির মেয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মারা যান এবং মিসেস কেনেডির মৃত্যু হয় ২-রা মে, সকালে৷ কিংসফোর্ড সেদিন একটু পরে ক্লাব থেকে বেরিয়েছিলেন৷

বোমা বর্ষণের পর ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী জুতো খুলে খালি পায়ে ধর্মশালার দিকে দৌড়ে পালাতে থাকেন৷ তাঁরা তখনও জানেন না গাড়িটি কিংসফোর্ডের নয় এবং তিনি সেখানে ছিলেন না। একটু পরেই তাঁরা আলাদা হয়ে যান।

ক্ষুদিরাম বসু রেল লাইন ধরে খানিকটা এগিয়ে সমস্তিপুর রোড ধরলেন, আর প্রফুল্ল চাকী অন্য পথ ধরলেন৷
এদিকে আশেপাশের সম্ভাব্য সমস্ত স্টেশনের রাস্তা সিল করে দেওয়া হয়েছে৷ ইতিমধ্যে, পায়ে হেঁটে মজফ্ফরপুর থেকে ওয়েনি স্টেশনে (বর্তমান নাম ক্ষুদিরাম বোস পুশা স্টেশন) যার দূরত্ব ৩৯ কিমি এসে পৌঁছলেন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী সকাল ৮টা নাগাদ৷
এখানে তাঁরা দু’জন আবার একসাথে মিলিত হন এবং কিছুক্ষণ একসাথে থাকেন। তারপর আবার আলাদা হয়ে যান।

ক্ষুধার্ত ক্লান্ত ক্ষুদিরাম বসু স্টেশনের এক দোকানে মুড়ি-জল খেতে গিয়ে এসআই রামাধার শর্মা এবং দু’জন (ফতে সিং এবং শিউপ্রসাদ) কনস্টেবল হাতে ধরা পড়লেন। কারন ক্ষুদিরাম বসুর সাথে কোনও বন্দুক বা বোমা ছিল না। সেই মুহূর্তে প্রফুল্ল চাকী সেখানে না থাকায় তিনি তখনকার মতো বেঁচে গেলেন৷ – এই পর্যন্ত ক্ষুদিরাম বসুর বয়ানে পাওয়া যায়।

এবার সেই সময়ের ব্রিটিশ পুলিশের বয়ানে পাওয়া যায় :
প্রফুল্ল চাকী ক্ষুধাকাতর অবস্থায় হাঁটতে শুরু করলেন ১৩ কিলোমিটার দূরের সমস্তিপুরের দিকে৷ যখন পৌঁছলেন তখন দুপুর হয়ে গেছে৷ এক বাঙালি নতুন জামাকাপড়-জুতো দিয়ে রাত্রের ট্রেনে মোকামার টিকিট কেটে দেন (যদিও এইব্যপারে সঠিক তথ্য বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই)।
এদিকে সিংভূমের এক এসআই নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়ে স্টেশনে ছিলেন – এবার নন্দলালের বয়ানে যা জানা যায় : প্ল্যাটফর্মে এক যুবকের পরনে নতুন জামাকাপড়-জুতো দেখে তাঁর কেমন সন্দেহ জাগে৷ গায়ে পড়ে ভাব জমালেন তিনি সেই যুবকের সঙ্গে এবং কিছুক্ষণ কথা বলে নন্দলালের আর কোনও সন্দেহ থাকে না, এই সেই অন্যতম যুবক যে বোমা ছুড়েছিল৷ সমস্তিপুর থেকে ট্রেনে উঠলেন প্রফুল্ল চাকী, তাঁকে অনুসরণ করে জনা তিনেক কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে নন্দলালও উঠলেন ট্রেনে৷ প্রফুল্ল চাকী আগেই বুঝে গিয়েছিলেন নন্দলাল তাঁকে অনুসরণ করছেন তাই তিনিও চেষ্টা করতে থাকেন নিজেকে আড়ালে রাখার৷ মোকামাঘাট স্টেশনে এসে প্রফুল্ল চাকী কলকাতায় আসার টিকিট কিনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন৷ সেই সময়ে নন্দলাল, রামাধার শর্মা, শিবশঙ্কর, জামির আমেদ ও আরও কয়েক জন কনস্টেবল মিলে প্রফুল্ল চাকী’কে ধরার চেষ্টা করেন৷ ধরা পড়ে গিয়েছেন বুঝতে পেরে প্রফুল্ল দৌড়তে শুরু করেন৷ কিন্তু সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এঁটে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ একেবারে শেষ পর্বে গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয় (২ মে ১৯০৮)।

এখন প্রশ্ন হল, গুলি কে করেছিল? ব্রিটিশ পুলিশের বয়ানে লেখা হয়েছে, প্রফুল্ল চাকী নিজের দিকে বন্দুক তাক করে আত্মহত্যা করেছিলেন৷ কিন্তু পুলিশ রেকর্ডে রাখা তাঁর মৃতদেহের ছবি অন্য কথা বলে৷ বিশ্লেষণ করেছিলেন
রাজ্য ফরেনসিক টেস্টিং ল্যাবরেটরি-র প্রাক্তন অধিকর্তা
নির্মলকুমার নাগ :-

যে, যে যুক্তিগুলি তাঁর আত্মহত্যার তত্ত্বকে সমর্থন করছে না সেগুলি সংক্ষেপে এইরকম :

১) প্রফুল্ল চাকী’র শরীরে যে-দু’টি গুলির ক্ষতস্থান দেখা যাচ্ছে, ফরেনসিক ও বিভিন্ন সমীক্ষার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে৷ কেননা, তিনি ডান-হাতি ছিলেন এবং ওই দু’টি স্থানে অর্থাত শরীরের বাঁ দিকে পিস্তলে নল ঘুরিয়ে নিজে-নিজে একটি নয় দু’টি গুলি করা রীতিমতো অসুবিধাজনক শুধু নয়, তা প্রায় অসম্ভবই (not within easy access)৷ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না৷

২) গুলির ক্ষতের আকৃতি এবং ব্যাস দেখে মনে হয় না এগুলি near contact অথবা contact shot-এর কারণে ঘটেছে, যা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সব সময় হয়ে থাকে৷

৩) আত্মহত্যার করলে শরীরের যে জায়গায়ে গুলি লাগে সেখানে কালো রঙের ছাপ দেখা যায়। প্রফুল্ল চাকীর ক্ষেত্রে সেখানে কোনও কালো ছাপ দেখা যায়নি।

৪) তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল৷ তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী! ছবিতে কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ ছিল।

৫) দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান নির্দেশ করে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই স্থানে গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব৷ প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন৷

৬) কোনও competent authority তো নেই, এমনকি কোনও ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সার্টিফিকেটও নেই৷

৭) শুধু ফোটো নেওয়া ছাড়া (দু’টি ছবিরই শুধু সন্ধান মেলে) পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য-কর্তব্যের কোনওটিই পালিত হয়নি৷ এবং তাই আসল সত্য নিয়ে এই এতদিন পরেও ধোঁয়াশা রয়ে যায়৷

সুদেহী প্রফুল্ল চাকী’র সঙ্গে গুলিভরা পিস্তল থাকতে বিনা বাধায় তিনি আত্মসমর্পণ করবেন এমন দুর্বল চিত্তের মানুষ তিনি ছিলেন না৷ কেউ কেউ বলেছেন, তিনি পুলিশের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়েছিলেন, তবে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷ অথচ, অন্য তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি পিস্তল ছোড়ায় দক্ষ ছিলেন, গুলি ছোড়ার রীতিমতো অভ্যাস করতেন মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে৷ তবে বিপদকালে উত্তেজনাবশে তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন, সেটাও হতে পারে। আসলে ব্রিটিশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে না চলে যায়। সেই সময়ের পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ পুলিশ দ্বারা বিপ্লবী হত্যার কথা প্রকাশ হলে তা প্রবল জনরোষের সম্ভাবনা থেকেই যেত। কিন্তু আত্মহত্যার কথা প্রচার করলে পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যেই থাকবে। তাছাড়া বোমার আঘাতে দুইজন সাধারণ ইংরেজ মহিলা মারা যাওয়ায় বিপ্লবী দলে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। তাই সেই সময়ের পরিস্থিতিতে সহানুভূতির হাওয়া ধরে রাখতে সবদিক ভেবেই এই আত্মহত্যার কথা প্রচার করা হয়। আসলে প্রফুল্ল চাকীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল।

প্রফুল্ল চাকীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ইনস্পেকটর নন্দলালকে হত্যা (৯ নভেম্বর, ১৯০৮) করে বদলা নেন অপর দুই বিপ্লবী – রনেণ গাঙ্গুলি ও শ্রীশচন্দ্র পাল।

তথ্যসূত্র:
@ প্রফুল্ল চাকী রহস্য: নির্মলকুমার নাগ (রাজ্য ফরেনসিক টেস্টিং ল্যাবরেটরি-র প্রাক্তন অধিকর্তা)।
@ কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম রাখা তথ্য।

 

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ