মুদ্রাদোষ কী?

বগুড়া নিউজ ডেস্কঃ প্রায় সব মানুষেরই কিছু না কিছু মুদ্রাদোষ আছে। রোজকার কথা বলা, হাঁটা-চলায় অস্বাভাবিকতা অনেকেরই প্রকাশ পায়। সে না বুঝলেও অন্যের চোখে ধরা পড়ে। কারও কারও ক্ষেত্রে এসব মুদ্রাদোষ এতটাই প্রবল হয়ে উঠে যে, একসময় মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভালো খবর হলো, এসবের চিকিৎসা আছে। তবে সচেতন হতে হবে শুরুতেই। নিচে দেখুন বিস্তারিত আলোচনা।

মুদ্রাদোষ না অন্যকিছু?

হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি। না চাইতেই সেই সব ভঙ্গিমা প্রকাশ পেয়ে যায়। অন‌্যরা দেখলে মনে করেন সেই ব‌্যক্তি হয়তো জেনে বুঝেই করছেন। অথচ তার অজান্তেই এমন হয়। সেগুলি কিন্তু স্নায়ুর সমস্যার জন্য কারণে হয়। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মোটর টিকস।

দেখুন তো লক্ষণগুলো মিলে যায় কিনা?

কেউ নাক বাঁকা করে, কেউ বা চোখ পিট পিট করেই চলে, কারও আবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়, কারও আবার ভুরু কোঁচকানো বা টানার প্রবণতা আছে, কেউ মুখ এমন কোঁচকায় মনে হয় প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে, কারও আবার কাঁধ তুলে ঘাড় বাঁকানোর অভ্যাস। এমনও হয় অনেকের বার বার জিভ বার করে ঠোঁটে লাগান কেউ আবার গোঁফে লাগান।

এছাড়া ভোকাল টিকসও হয়। সেক্ষেত্রে রোগী বার বার গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে, জোরে কিংবা আস্তে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বা শব্দ গলা দিয়ে বার করে, বা কথায় কথায় গালাগালি করার প্রবণতা দেখা দেয়। আসলে মোটর টিকসের ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে এবং ভোকাল টিকসের ক্ষেত্রে রোগীর গলায় এমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে। তাই যতক্ষণ না ওই অদ্ভুতরকম অঙ্গভঙ্গি বা আওয়াজ বের করছেন একজন ততক্ষণ ওই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ দুরূহ হয়ে পরে।

কোনোরকম দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, গ্লানি, উত্তেজনা বা উচ্ছ্বাস হলে এগুলি বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ ১৮ বছর বয়সের আগেই আরম্ভ হয়। তবে সতর্ক হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এগুলি সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়। খুব অল্প ক্ষেত্রেই মুদ্রাদোষ প্রাপ্তবয়স্কদের দেখা যায়। এই বয়সে এমন রোগ শুরু হলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিরাময় সম্ভব। মুদ্রাদোষ থাকলে এই প্রতিক্রিয়ার উপর রোগীর কোনো নিয়ন্ত্রণ (ইনভলান্টারি) থাকে না, অস্বস্তির দূর করার জন্য শরীর নিজে নিজেই এমন সব অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া করে।

তোতলামি ও তার কারণ

কথা আটকে যায় ও তার সঙ্গে রোগী একটা নির্দিষ্ট অক্ষর বা স্বরবর্ণ বার বার উচ্চারণ করতে থাকে। মুদ্রাদোষের মতোও তোতলামিও কোনোরকম দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, গ্লানি, উত্তেজনা, রাগ বা উচ্ছ্বাস হলে বেড়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে এই রোগ প্রকাশ পায়, যখন তারা অনেক বেশি মাত্রায় বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করতে শেখে। গবেষণা বলে ৭০% ক্ষেত্রে শিশু বয়সে তোতলামি নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। তবে এক বছর অবধি ঠিক না হলে বুঝে নিতে হবে যে স্পিচ থেরাপিস্ট ছাড়া রোগ সারানো মুশকিল। খুব বিরল ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের এই রোগ থাকে। তোতলামির ক্ষেত্রেও রোগীর রোগের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না (ইনভলান্টারি)।

শুচিবায়ু

যাদের আমরা চলতি কথায় বলি শুচিবাই। যেমন, সবসময় নোংরা মনে করে একই জায়গা বা জিনিস বারবার পরিষ্কার করার প্রবণতা। এক্ষেত্রে রোগীর মাথায় বারবার একটা চিন্তা আসতে থাকে। যেটা হল অবসেশন। আর সেটাকে দূর করার জন্য রোগী বার বার একই কাজ করে যায় যেটা হল কম্পালশন। এই কম্পালশনের ক্ষেত্রে রোগী নিজের ইচ্ছায় সেসব ভাবে বা করে তার নানা ধরন রয়েছে।

অবসেশনাল থিমস অ‌্যান্ড রুমিনেশন

এক্ষেত্রে বারবার একটা চিন্তা ঘুরে ঘুরে আসে। কিছুতেই সেই চিন্তা সে মাথা থেকে দূর করতে পারে না। রোগী বার বার নিজের অতীতের কথা ভেবে ভুল করেছে বা যা তার করা উচিত ছিল করেনি এবং সেটা ভেবে অপরাধ বোধ, নিজের প্রতি রাগ বা অনুশোচনা জাগে।

বডি ডিসমর্ফিক ডিসঅর্ডার

রোগীর মনে হতে থাকে যে তার চেহারায় কোনো ত্রুটি রয়েছে। নাকটা বাঁকা, বা চুলটা ঠিক ভাবে আঁচড়ানো নেই, হয়তো তার একটা চোখ অন্য চোখের চেয়ে ছোট ইত‌্যাদি নানা কারণে সে খুঁতখুঁত করতে থাকে।

হাইপোকোনড্রিয়াসিস

রোগী সবসময় মনে হতে থাকে তার গলায় কিছু একটা হয়েছে, বা তার পেটে কোনো একটা মারাত্মক রোগ হয়েছে।

অবসেশনাল ফোবিয়া

যেমন রোগীর সামনে ছুরি থাকলে তা দিয়ে খুন করে ফেলবে এমন একটা ভয় তার মধ্যে কাজ করে। কোনো খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলার চিন্তা মাথায় আসে।

অবসেশনাল ইম্পালস

গাড়িতে চড়লেই রোগীর মনে হয়ে যে সে চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেবে। কোনো সামাজিক বা ধার্মিক অনুষ্ঠানে গেলে তার মনে হতে পারে যে সে কাউকে গালাগালি দিয়ে ফেলবে। রাস্তায় চলার সময় লাইট পোস্ট ছুঁতে ছুঁতে যায়। এমন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

অবসেশনাল ডাউটস

একটা কাজ করে বারবার চিন্তা করা যে কাজটা করেছে কি না, যেমন- তালা লাগিয়ে বার বার তালাটা টেনে দেখা যে তালা ঠিক মতো লাগানো হয়েছে কিনা। ঠিক মতো গোনা হয়েছে কিনা।

সোম্যাটিক অবসেশন

রোগীর মনে হয় যে তার শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়া যেমন- শ্বাস নেওয়া, পলক ফেলা, খাবার খাওয়া, সব অঙ্গের অবস্থান, স্বাভাবিক চুলকানি, পেট ভর্তি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যেই কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে। অথচ চিকিৎসকের কাছে গেলে বা টেস্ট করলে কোনো সমস‌্যাই ধরা পড়ে না।

এমন রোগের কারণ

গবেষণায় বলে যে মস্তিষ্কের বেসাল গ‌্যাংলিয়ায় কোনো সমস‌্যা থাকলে এমন রোগ হতে পারে। এছাড়া আমাদের একটা স্নায়ু থেকে আরেকটা স্নায়ুর যোগাযোগের জন্য যে নিউরোট্রান্সমিটার (কেমিক‌্যাল ম‌্যাসেনজার) থাকে তাদের মধ্যে একটি রাসায়নিক পদার্থ সেরোটোনিনের মেটাবলিসম এর গন্ডগোলের ফলেও এমন হতে পারে।

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত?

► রোগী বা তার আত্মীয়-পরিজন বুঝতে পারছে যে তার অবসেশন এবং কম্পালশন দুই ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা রয়েছে, চেষ্টা করছেন তা নিয়ন্ত্রণে আনার কিন্তু পারছেন না।
► দিনে কয়েক ঘন্টা নিজের অবসেশন এবং কম্পালশন নিয়ে সময় কাটালে সাবধান।
► অবসেশন জনিত ভাবনা চিন্তা থেকে কম্পালসিভ বিহেভিয়ার বা কাজ করে শান্তি না মিললেও মনের অস্বস্তি কাটে।
► এমন কিছু চিন্তাভাবনা বা কার্যকলাপ করেন যার জন্য দৈনন্দিন জীবনযাপন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
► আপ্রাণ চেষ্টা করা সত্ত্বেও সবসময় রোগীর মাথায় ওই ব্যাপারগুলি ঘোরাঘুরি করে এবং মানসিক কষ্ট চলতে থাকে।

চিকিৎসা

কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি- এক্সপোজার উইথ রেসপন্স প্রিভেনশন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, হাত ধোয়ার বাতিক কারও আছে তাকে এই থেরাপি করা হলে প্রথমে বলা হয় হাতে নোংরা আছে তা সত্ত্বেও সে যেন সঙ্গে সঙ্গে হাত না ধোয়। এতে বারে বারে হাত ধোয়ার প্রবণতা কমতে থাকে।

ওষুধ- মূলত এসএসআরআই (সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর্স)- যার মধ্যে অনেকগুলি ওষুধ পড়ে। এই ওষুধগুলি কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির সাঙ্গে চিকিৎসক প্রয়োজন মতো দিয়ে থাকে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০