বগুড়া নিউজ ২৪ঃ নানা কারণে ঘটনাবহুল কেটেছে ২০১৯। দেশে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ, ব্রিটেনে রাজনীতির পট পরিবর্তন, ভারতের নির্বাচনে বড় জয় নিয়ে মোদির ফেরা, মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিশংসনের মতো ঘটনার পাশাপাশি বিশ্বের জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গের বজ্রকণ্ঠ এই বছরকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বছরব্যাপী বিশ্বের উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা ঘটেছে এইসময় পাঠকদের জন্য তার এক ঝলক-
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুটি- প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। এবং দ্বিতীয়টি অভিশংসনের তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সিনেটে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হবে। সেখানে ট্রাম্পের দলের সদস্য বেশি থাকায় তাকে কোনো বিপদে পড়তে হবে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।
ব্রিটেনে নির্বাচন ও ব্রেক্সিট
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার প্রক্রিয়া (ব্রেক্সিট) নিয়ে কয়েক বছর ধরে উত্তপ্ত ছিল ব্রিটেনের রাজনৈতিক অঙ্গন। এই বিল পাস করতে ব্যর্থ হয়ে বিদায় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে। তারপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এই চুক্তি পাস করতে ব্যর্থ হন বরিস জনসন। সর্বশেষ আগাম নির্বাচনে ভোট দেন ব্রিটিশরা। সেখানে ধারণার চেয়েও বড় জয় পেয়ে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন বরিস। আগামী ৩১ জানুয়ারি ব্রেক্সিট সম্ভব হবে বলে ক্ষমতায় ফিরেই জানিয়েছেন বরিস।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল
ভারতের বিশেষ রাজ্য হিসেবে এতদিন মর্যাদা পেয়ে আসছিল কাশ্মীর। কিন্তু চলতি বছরে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি কাশ্মীরের বিশেষ মযার্দা সম্বলিত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে। এছাড়া রাজ্য ভেঙে দিয়ে কাশ্মীরকে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। সেই ঘটনার কয়েকমাস পরও এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি কাশ্মীর।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারতে যাওয়া ইসলাম ব্যতিত বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে মর্মে আইন পাস করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। এছাড়া গোটা দেশে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চালু হবে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। এরফলে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা করছে। এতে বেশ কয়েকজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘের আদালতে রোহিঙ্গা মামলা ও শুনানি
নেদারল্যান্ডসের হেগে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। সেই মামলার শুনানিতে মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে বক্তব্য দেন গাম্বিয়ার আইনজীবী আবু বাকার তামাদুর। শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দেন দেশটির কার্যত সরকার প্রধান অং সাং সু চি। শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক আদালত জানিয়েছে, খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে তারা একটি সিদ্ধান্ত দেবেন।
দেশে দেশে বিক্ষোভ
ইকুয়েডর
অক্টোবরে ইকুয়েডরে দেখা দেয় প্রবল বিক্ষোভ। সরকারি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে সরকার হঠাৎ করেই জ্বালানীতে ভর্তুকি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, বহু বছর ধরে চলে আসা এই ভর্তুকি যখন সরকার বন্ধের ঘোষণা দেয় তখনই বিক্ষোভের শুরু।
ভর্তুকি বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর দেশটিতে পেট্রোলের দাম অনেক বেড়ে যায়। ফলে, বিক্ষোভকারীরা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং ভর্তুকির দাবীতে আন্দোলনে নেমে রাজপথ বন্ধ করে দেয়, সংসদে হামলে পড়ে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। অবশেষে, আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হঠে এবং জ্বালানী তেলে ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।
চিলি
চিলিতে আন্দোলন দানা বাঁধার পেছনেও রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানী তেলের উচ্চ মূল্য এবং দেশটির দুর্বল মুদ্রার কারণ দেখিয়ে চিলি সরকার বাস ও মেট্রোর ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ছিল গরীবের উপরে সরকারের আরেকটি খাঁড়ার ঘা। দাক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ধনী দেশ চিলি। কিন্তু দেশটিতে তীব্রভাবে ধন-বৈষম্য বিরাজমান। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের যে ৩৬টি দেশ রয়েছে তার মধ্যে চিলিতেই সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্য রয়েছে।
ইকুয়েডরে যেমন জ্বালানী তেলের ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করেছে, চিলিতেও ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকার বাতিল করেছে।
লেবানন
লেবাননেও বিক্ষোভ ছড়িয়েছে কর আরোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। হোয়াটসঅ্যাপ কলের ওপর করারোপের সিদ্ধান্ত নেয় লেবানিজ সরকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে ওঠে। যদিও ঋণের ভার বাড়ছে, তবু আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে সরকার নানান অর্থনৈতিক সংস্কার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষেরা বলছেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণীর বলি হিসেবে তারা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
লেবাননে বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছিলেন, অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তাদের যখন জেরবার হচ্ছে তখন দেশের নেতা-নেত্রীরা তাদের পদ-পদবী কাজে লাগিয়ে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানান কায়দায় নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
বিক্ষোভ সামাল দিতে একটি সংস্কার প্যাকেজ অনুমদোন দেয় সরকার। এই প্যাকেজের আওতায় রাজনীতিবিদদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পদত্যাগ করেন দেশটির সেসময়ের সরকারপ্রধানও।
ইরাক
ইরাকেও চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এর ইতি টানার আওয়াজ তুলেছে ইরাকি জনতা। ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ, মেধার ভিত্তিতে সরকারী কাজে নিয়োগ না দিয়ে জাতিগত ও অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে নেতা-নেত্রীরা নিজেরা এবং তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে পাবলিক ফান্ড বা সরকারী কোষাগারের অর্থ কোনো কাজেই আসছে না। বেশ কয়েকদিন আগে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখনো চলছে। তবে এরই মধ্যে সরকার দেশটিতে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মিশর
স্পেনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর ডাকে গত সেপ্টেম্বরে মিশরে বিক্ষোভ দেখা দেয়। আলী মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। সরকারি ফান্ডের টাকা প্রেসিডেন্ট সিসি এবং তার সরকার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তুলেন আলী। সরকারের কৃচ্ছতা নীতির কারণে ভোগান্তিতে থাকা সাধারণ মানুষের ছিল একই অভিযোগ।
হংকং
সরকারি একটি বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে এই গ্রীষ্মে হংকংয়ে বিক্ষোভের সূত্রপাত। বিলটিতে বলা ছিল, কোনো অপরাধী ব্যক্তিকে কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চীনের মূল ভূখণ্ডে হস্তান্তর করা যাবে।
হংকং চীনের অংশ হলেও এই স্থানটি বিশেষ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। কিন্তু হংকং এর মানুষের মধ্যে এই বোধ তীব্র হচ্ছে যে, বেইজিং তাদের উপরে আরো বেশি মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। চিলি ও লেবাননের মতই হংকং-এর বিক্ষোভেও কাজ হয়েছে। বিতর্কিত বিলটি প্রত্যাহার করেছে কর্তৃপক্ষ।
বলিভিয়া
বিতর্কিত পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস যখন নির্বাচনে পুনরায় জয় লাভ করতে যাচ্ছিল তখন বলিভিয়াতে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সংঘর্ষে জড়ায়।
প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ কয় মেয়াদে থাকতে পারবে এই বিষয়ক বিধানকে মোরালেস যখন বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছিল ২০১৬ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে মানুষ তার সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু আদালতে গিয়ে মোরালেসের পার্টি নিজেদের পক্ষে রায় পায় এবং টানা চতুর্থ বারের মতন তার আবার প্রেসিডেন্ট হবার পথ উন্মুক্ত হয়। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ব্যাপক বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন মোরালেস।
জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন
বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা বিক্ষোভগুলোর মধ্যে অনেক জায়গায় অন্যতম বিষয় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন। ‘এক্সটিংশান রেবেলিয়ন’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে জলবায়ু পরিবর্তন টেকাতে সরকারগুলোর কাছ থেকে আশু পদক্ষেপের দাবি জানায় বিক্ষোভকারীরা।
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ডের মত দেশগুলোতে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে।
১৬ বছর বয়সী সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থানবার্গ জলবায়ু আন্দোলনের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।