কাজ না করেই লোপাট ৪১০ কোটি টাকা!

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় লেকের জমি অধিগ্রহণ, লেক খনন ও উন্নয়ন, ওয়াকওয়ে, কজওয়ে, ড্রাইভওয়ে নির্মাণ দেখিয়ে ৪১০ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা লুটপাট করে নেয়া হয়েছে। অথচ এসব কাজ করাই হয়নি। প্রকল্পের পিডির গাফিলতির কারণে লেক উন্নয়ন প্রকল্পে বেহাল দশা বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।

দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পে চিঠি চালাচালি চলছে। প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দশবার চিঠি দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে। আর রাজউকর থেকে জবাব আসে একবার। এছাড়া দুই বছর আগে একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা মানছে না গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্পের পরিচালক। ওপি-প্রকল্পগুলোর ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এদিকে গুলশান-বনানী-বারিধারার লেক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের উপর রাজউকের বোর্ড সভার মতামতসহ প্রস্তাব এ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সেই প্রস্তাব এখনো পায়নি মন্ত্রণালয় বলে জানা গেছে। গতবছর জমি অধিগ্রহণের টাকা চেয়ে রাউজক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসক। সে টাকা এখনো পায়নি বলে ডিসি অফিস সূত্রে জানা গেছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ইনকিলাবকে বলেন, প্রকল্প পরিচালকদের লাখ লাখ টাকা দামের গাড়ি দেয়া হয় হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কিন্তু আপনি যদি সেই গাড়িতে চড়ে গুলশান-বনানী ঘুরে বেড়ান তাহলে কেমন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন বৃদ্ধি পাবে? পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, জনগণের টাকায় গাড়ি কেনা হচ্ছে। সেই গাড়ি থাকছে ঢাকায়। কিন্তু কাজ গ্রামে। এটা অদ্ভুত বিষয়। হাওরে প্রকল্প হচ্ছে কিন্তু আমি জানি না। জনগণ জানতে চায়, আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। তাই পারস্পরিক দোষারোপ না করে আসুন সবাই মিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দিই। রাজউকের অনেক প্রকল্প হচ্ছে সেগুলোর পরিকল্পনা কমিশনে তথ্য নেই। সে জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। রাজউকের একজন কর্মকর্তা একাধিক প্রকল্পের পরিচালক পদে রয়েছেন। এ বিষয়গুলোর তথ্য চাওয়া হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গুলশান-বনানী-বারিধারার লেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ না করে ৪১০ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার ব্যয় দেখিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব, সাবেক চেযারম্যান আব্দুর রহমান- প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. মোমিতুর রহমান, সিনিয়র সহকারী সচিব নজরুল ইসলাম মিলে প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. মোমিতুর রহমানকে দুদক নোটিশ দিয়েছে।

অদক্ষতা ও গাফিলতির জন্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বেহাল দশা শুরু হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প এক নম্বরে। এ প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান একাই রাজউকের ৩-৪টি প্রকল্পের পরিচালক। তিনি একটি প্রকল্পের তিন ভাগ টাকা তুলে নিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে নতুন করে অন্য প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্প ৪১০ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। মোট প্রকল্পের ব্যয়ের বিপরীতে ৭৪ দশমিক ৬১ শতাংশ দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের মোট বাস্তব অগ্রগতি ভৌত খাতে ৭৫ শতাংশ এবং আর্থিক খাতে ৭৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতিতে বলা হয়েছে রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় লেকের জমি অধিগ্রহণ, লেক খনন ও উন্নয়ন, ওয়াকওয়ে, কজওয়ে, ড্রাইভওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে তা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ গত বছর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সচিব মো, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি দেখতে পাননি। অথচ কাজ না করে রাজধানীর গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় লেকের জমি অধিগ্রহণ, লেক খনন ও উন্নয়ন, ওয়াকওয়ে, কজওয়ে, ড্রাইভওয়ে নির্মাণ ব্যয় দেখিয়ে ৪১ কোটি টাকা প্রকল্পের নামে তুলে নেয়া হয়েছে। এখনো জমির মালিকরা জমি অধিগ্রহণের টাকা পায়নি অথচ প্রকল্পের প্রতিবেদনে টাকা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কি কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। এ খবরে বলা হয়েছে আরডিপিপি অনুমোদন বিলম্ব, মামলাজনিত কারণে বিলম্ব হচ্ছে। মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুনর্গঠিত সংশোধিত ও ডিপিপি অনমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

রাজউকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গুলশান-বনানী-বারিধারার লেক উন্নয়ন প্রকল্পে পরিচালক আমিনুর রহমান, উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও তিনি। কুড়িল-পূর্বাচল লিংক উভয় পার্শ্বের ১০০ ফুট চওড়া খাল খনন প্রকল্পের পিডি এম এস এহসান জামিল, আরমান রিজিলেন্স প্রজেক্টের পিডি আবদুল লতিফ হেলালী, হাতিরঝিল প্রকল্পের দূষিত পানি ও পরিশোধন প্রকল্পের পিডি এ এস এম রায়হানুল, মাদানী এভিনিউ থেকে বালু নদী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পিডি এম এস এহসান জামিল, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক, উত্তরা ১৮ নং সেক্টরে নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগোষ্ঠির জন্য অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ প্রকল্পের পিডি মো: মুজাফফর উদ্দিন, ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি মো. নুরুল ইসলাম, ঢাকা, গুলমান, মোহাম্মদপুর লালমাটিয়া ও ধানমন্ডি এলাকায় ৯টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণ প্রকল্পের পিডি রাহাত মুসলেমীন দায়িত্ব রয়েছেন। তবে তাদের প্রতিবেদনে এক জায়গায় মিল রয়েছে সেটি হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ ও মামলাজনিত সমস্যা।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. বরকাতুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন গুলশান-বনানী-বারিধারার লেক উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের উপর রাজউকের বোর্ড সভার মতামতসহ প্রস্তাব এ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য নিদেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।

গত ১১ আগস্ট তারিখে একনেক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভা সিদ্ধান্তের প্রকল্প এলাকায় কড়াইল বস্তি উচ্ছেদ বসবাসরত মানুষের সংখ্যা, পুনর্বাসন পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। আবারো মন্ত্রণালয় থেকে একই চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রকল্পর ভূমি অধিগ্রহণের, পুনর্বাসন, পরিবেশগত, সামাজিক, কারিগরি এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসহ বিস্তারিত সমীক্ষা চাওয়া হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় প্রকল্পে এলাকায় বড়াইল বস্তি পড়েছে কি না তা জানতে চান। কিছু তখন সাবেক চেয়ারম্যান কিছুই বলতে পারেনি। সে কারণে বার বার চিঠি দেয়া হচ্ছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারা লেকের কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ তথ্য জানতে পেয়ে রাজউকের কর্মকর্তারা বার বার ভুল তথ্য পাঠাচ্ছে। কারণ এ প্রকল্পে সেনাবাহিনী বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিলে সেখানে কর্মকর্তারা দুর্নীতি করার সুযোগ পাবে না।

প্রকল্প এলাকার বাসিন্দার আল আমিন বলেন, প্রকল্পের কোনো কাজ না করে ৪১০ কোটি টাকা প্রকল্পের পরিচালক তুলে নিয়েছে আর আমরা জমির টাকা পাচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই এই ধরনের প্রকল্পের পরিচালকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিন। তা না হলে দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি হবে। এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার ইনকিলাবকে বলেন, গুলশান-বনানী-বারিধারার লেকের প্রকল্পের সংশোধনের প্রস্তাব আমরা একনেকে পাঠাব।

এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মো: সাঈদ নূর আলম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পেয়েছি। এ নিয়ে কাজ চলছে। কি কারণে প্রকল্পের কাজ দেরি হয়েছে এবং প্রকল্পের পরিচালকের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে।
উৎসঃ ইনকিলাব

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ