ইউরোপে প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ বহু আলোচনার পর অবশেষে এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে গত বুধবার মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তির অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপের পার্লামেন্ট। চুক্তির ফলে বেশ কিছু পণ্যে সঙ্গে সঙ্গেই শুল্ক প্রত্যাহার হবে। আর বাকি পণ্যে আগামী ১০ বছরে উভয় অঞ্চলের আমদানি-রপ্তানিতে শুল্ক শূন্যে নেমে আসবে।

বর্তমানে ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যে ১২ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হয় ভিয়েতনামের পণ্যে। ভিয়েতনাম ইউরোপে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে সেখানে বাংলাদেশি পণ্য বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে ভিএন এফটিএ নামের এই চুক্তি ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। কেননা, বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ মনে করা হয় ভিয়েতনামকে। অর্থনীতিবিদেরাও বলছেন, এই চুক্তির ফলে সার্বিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ইউরোপে রপ্তানি বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। এর মধ্যে স্বল্পোন্নত হিসেবে বেশি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে। কেননা, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগেই শিল্পপণ্য রপ্তানিনির্ভর নয়, কৃষিপণ্যই তাদের মূল পণ্য। এর মধ্যে শিল্পপণ্য রপ্তানিকারক হিসেবে কম্বোডিয়া, নেপাল, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশ এই চুক্তির ফলে বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে ইউরোপের বাজারে সব ধরনের রপ্তানি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভিয়েতনামকে পরিশোধ করতে হয় ৮ থেকে ১২ শতাংশ শুল্ক। পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে এই শুল্ক প্রায় শূন্যে নেমে আসবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর ২০২৭ সালের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না ইউরোপের বাজারে। তখন বাংলাদেশকে বাড়তি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক ইত্তেফাককে বলেন, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ইউরোপের বাজারে ভিয়েতনাম বাড়তি সুবিধা পাবে। বর্তমানে ইউরোপে ভিয়েতনামের রপ্তানি ৪ বিলিয়ন ডলারেরও কম। কিন্তু এই সুবিধা পাওয়ার পর তারা দ্রুত ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করবে। কেননা, তারা মুদ্রা বিনিময় হার, দক্ষতা, মূল্য সংযোজনের সক্ষমতা, অপেক্ষাকৃত কম লিড টাইম (ক্রয়াদেশের পর ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠানো পর্যন্ত সময়), পণ্য বহুমুখীকরণের সক্ষমতা এবং সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে পিছিয়ে থাকায় এখন দ্রুতই ইউরোপের বাজার বিশেষত গার্মেন্টস বাজার দখলে নিতে পারবে ভিয়েতনাম। এর ফলে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, এই চুক্তির ফলে স্বল্প মেয়াদে প্রভাব সীমিত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যে প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপের বাজারে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম ইউরোপে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে না।

অবশ্য এই চুক্তির আওতায় কেবল বাণিজ্য নয়, বিনিয়োগ, প্রতিযোগিতা নীতি, সেবা খাত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই সঙ্গে শ্রম অধিকারের বিষয়টি যুক্ত থাকায় ভিয়েতনামের শ্রম অধিকার ইস্যুটি ইউরোপের মানবাধিকারবিষয়ক নীতিমালা মানতে হবে।

এই চুক্তির ফলে ২০৩৫ সাল নাগাদ ইইউতে ভিতেনামের রপ্তানি বিদ্যমান অবস্থা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি ইউরোতে দাঁড়াবে। অন্যদিকে ভিয়েতনামে ইইউর রপ্তানি ২ হাজার কোটি ইউরো ছাড়াতে পারে।

ভিয়েতনাম ইইউভুক্ত ২৮টি দেশে বর্তমানে গার্মেন্টস পণ্য ছাড়াও টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি ও খাদ্যপণ্য, পাদুকা, ওষুধ রপ্তানি করে। ভিয়েতনামের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানি ৪৩ শতাংশ বাড়বে। ভিয়েতনামের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ইউরোপের বড়ো বিনিয়োগ রয়েছে দেশটিতে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইইউ দেশটিতে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ২০১৮ সালে ভিয়েতনাম শুধু টেক্সটাইল ও পাদুকাশিল্পে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করেছে। আগামী সাত বছরে ধারাবাহিকভাবে নতুন চুক্তি কার্যকর হলে এই রপ্তানির আকার আরো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়ে যাবে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এছাড়া বাংলাদেশের মোট গার্মেন্টস রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশি যায় ইউরোপের বাজারে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ