বগুড়া নিউজ ২৪ঃ অগুনতি মানুষ আছে। তবে তাদের দেখা মিলছে না, পিলপিল পায়ে যারা ছুটত যানবাহন ধরার জন্য বা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সে রকম কাউকেই দেখা গেল না। কারো কারো দেখা মিললেও মুখ দেখা যাচ্ছে না, মাস্কে ঢাকা। দুই হাতে দস্তানা।
বাস টার্মিনালে, সড়কের পাশে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে। ঢাকার কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলস্টেশন কোলাহলহীন। শব্দ তুলে আর ছুটছে না ট্রেন। বুড়িগঙ্গা নদীর ঘাটে ভিড়ছিল না দূরের নৌযান।
আগের রাত থেকেই ‘ভূতুড়ে’ হয়ে উঠা সড়কে ছিল পুলিশের গাড়ি, সেনা সদস্যদের টহল। মাঝেমধ্যে পণ্যবাহী গাড়ি ছুটে চলছিল। কোনো রোগী নিয়ে যাচ্ছিল অ্যাম্বুল্যান্স।
প্রধান সড়ক, অলিগলির মুদি, ওষুধের দোকান বা কাঁচাবাজারের দোকান ছাড়া সব দোকানপাটই বন্ধ। সকাল-বিকাল যে চায়ের দোকানে আড্ডা চলত, সেটিও খোলা ছিল না।
গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে টানা ১০ দিনের জন্য সাধারণ ছুটি শুরুর দিনে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের চিত্র ছিল এমনই।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ওষুধ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অন্যান্য বছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন থাকলেও এবার গণজমায়েতের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় স্বাধীনতা দিবসে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। গতকাল সকাল ৯টায় রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে রওনা দিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত হেঁটেই চলতে হলো। গোলচত্বরে বাস দাঁড়ানোর স্থানটি খাঁ খাঁ করছিল। ১৫ মিনিট দাঁড়ানোর পর আনিসুর রহমান নামে একজনের দেখা মিলল। বললেন, বারডেম হাসপাতালে যাওয়ার কোনো বাহনই পাচ্ছেন না। চোখে তাঁর উদ্বেগ।
প্রায় দুই কোটি মানুষের শহরের প্রায় সব এলাকায় মানুষকে রাস্তায় খুব একটা দেখা যায়নি। যানবাহনও ছিল খুবই কম।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে পাশের দেশ ভারতে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার দেশে লকডাউন ঘোষণা না করলেও গতকাল শুরু হওয়া ১০ দিনের সাধারণ ছুটির প্রথম দিন কার্যত লকডাউন ছিল দেশ। ‘ঘরবন্দি’ ছিল মানুষ। তবে গণপরিবহন বন্ধ করার আগে ছুটি ঘোষণা করায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে রাজধানীর অনেক মানুষ। গত বুধবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এর আগে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়িয়ে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। আগে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতিও ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব বিপণিবিতান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান, যেমন—মুদি, ওষুধ, খাবারের দোকান খোলা থাকবে।
তবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও নগদ লেনদেনের সুবিধার্থে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে। এই সময়ে এটিএম বুথগুলোয় পর্যাপ্ত অর্থ রাখতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোয় সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাঠে নেমেছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে তাঁরা হোম কোয়ারেন্টিন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। বিদেশফেরত ব্যক্তিরা নির্ধারিত সময় হোম কোয়ারেন্টিন ঠিকমতো পালন করছেন কি না, সেটিও দেখছেন তাঁরা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজও করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।
চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চল থেকে ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় ভাইরাস সংক্রমিত রোগী থাকলে চিকিৎসা এবং বিদেশফেরত নাগরিকদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করাসহ সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তায় নৌবাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।
এরই অংশ হিসেবে নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম নৌ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ঘরে বসে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম মাহবুব শিকদার।
এ ছাড়া গতকাল ছুটি শুরুর প্রথম দিনে শহরের রাস্তায় কিছু রিকশা দেখা গেলেও অন্য যানবাহন ছিল খুবই কম। সরকারের নির্দেশনা মেনে মুদি ও ওষুধের দোকান এবং কাঁচাবাজার ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ ছিল।
বিভাগীয় নগরী সিলেটের চিরচেনা রূপ পাল্টে গেছে। গতকাল সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। মার্কেটগুলোও বন্ধ ছিল। সকাল থেকে জেলায় টহল শুরু করেছে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশও টহলে ছিল। প্রচারযন্ত্রে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছিল। সড়কগুলোয় দু-একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল ছাড়া কোনো গণপরিবহন চোখে পড়েনি। রিকশাও চলছিল না রাস্তায়। সিলেটের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) মো. মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সকাল থেকে সিলেটে সেনাবাহিনীর টহল শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যত দিন প্রয়োজন সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। সিলেটের বিয়ানীবাজারে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করতে গতকাল মাঠে ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। প্রবাসীবহুল এ উপজেলায় প্রবাসফেরত ব্যক্তিদের বিশেষভাবে ঘরবন্দি রাখতে তত্পরতা রয়েছে প্রশাসনের। বরিশাল জেলার সব খেয়া পারাপার বন্ধ করা হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অধিকাংশ স্থানে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোয় মানুষের মধ্যে ঘরে থাকার প্রবণতা বেড়েছে।
কুমিল্লা শহরের নিউ মার্কেট, রাজগঞ্জ, চকবাজার, কাঁসারিপট্টি চৌমুহনী, তেলিকোনা, ছাতিপট্টি ও কান্দিরপাড় এলাকায় জরুরি প্রয়োজনে খোলা দোকানপাট, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকানে গিয়ে কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, তা চিহ্নিত করে দেয় টহলদল। পরবর্তী সময়ে এর ব্যত্যয় হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে টহলদল সতর্ক করে দেয়। শহরের প্রধান প্রধান সড়কে সতর্কতামূলক নিয়ম পালনের জন্য মাইকিং করা হয়।
কুড়িগ্রামে গতকাল সকাল থেকে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যৌথ ভ্রাম্যমাণ দল শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দেয়। যৌথ টহলদল জনসমাগম রোধ, জীবাণুনাশক ছিটানো ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কর্মসূচি পরিচালনা করে। যৌথ টহলদলের নেতৃত্ব দেন নির্বাহী হাকিম সুদীপ্ত কুমার সিংহ।
গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ওপর কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে। দিনাজপুরের মানুষ ঘরমুখো হয়েছে। কাঁচামাল ও খাদ্যসামগ্রীর দোকান ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় পেলে পুলিশ লাঠিপেটাসহ শাস্তি দিচ্ছে। করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে হ্যান্ড মাইকে প্রচার চালাচ্ছিলেন সেনা সদস্যরা। জীবাণুনাশক ছিটান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। জটলা দেখলেই মৃদু লাঠিপেটায় ছত্রভঙ্গ করছিল থানার পুলিশ।
[এ প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট অফিস, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি]