হাতে গড়া শিক্ষা নিকেতনে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান

ষ্টাফ রিপোর্টারঃ শনিবার সকাল ১০টায় মহাস্থানগড় শাহ্ সুলতান বলখীর (র) মাজারসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে তাঁর নিজ হাতে গড়া রিয়াজুল জান্নাত বহুমুখী ইসলামি শিক্ষা নিকেতন ও দুস্থ সেবা কেন্দ্র চত্বরে চির নিদ্রয় শায়িত হলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। হাজারো জনতা তার জানাজায় অংশগ্রহন করেন।
পারিবারিক সুত্রে জানাযায়,এক মাস আগে কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হন তিনি। এরপর কখনো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ), কখনো কোভিড ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে করোনার সঙ্গে লড়েছেন। দুদিন আগে আরেক দফা নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে তিনি কোভিড ১৯ ‘নেগেটিভ’ শনাক্ত হন। তবে হাসপাতাল ছাড়া হয়নি তাঁর। আইসিইউতেই মারা গেছেন তিনি।
গত ১০ জুন মেডিকেল কলেজে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। ১১ জুন তিনি টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে কোভিড পজিটিভ শনাক্ত হন। ১৩ জুন তিনি হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন। প্রথম দিকে টানা কয়েক দিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন। কিছুটা উন্নতি হওয়ায় পরে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। ৭ জুলাই আরেক দফা নমুনা পরীক্ষায় তাঁর শরীরে কোভিডের জীবাণু মেলেনি। কিন্তু এরপরও শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটলে আবারও তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তিনি মারা যান। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন।
ইতিহাস গবেষণা ও প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ ছাড়াও আবদুল মান্নান দুনিয়া ঘুরে কয়েক শ বিলুপ্ত ও দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ, ফলদ, বনজ ও ভেষজ গাছের চারা সংগ্রহ করে বাগান ও নার্সারি গড়েছেন। এসব বিলুপ্ত ও দুর্লভ প্রজাতির গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণা করেছেন। বগুড়াসহ দেশজুড়ে সবুজ প্রকৃতি গড়ার কাজ করেছেন। এসব কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। অসুস্থ পাখির চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার মাধ্যমে ‘প্রাণিবন্ধু’ হিসেবে সুনাম ছিল তাঁর।
দেশজুড়ে নানা প্রতিষ্ঠানে বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা গাছ লাগিয়ে ‘সবুজ বিপ্লবের নায়ক’ হিসেবে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত আবদুল মান্নান। বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকায় গড়েছিলেন ‘সবুজ নার্সারি’। সেখানে মিলত বিদেশি জাতের দুর্লভ নানা গাছের চারা। তাঁর হাত ধরে মহাস্থানগড় এলাকায় ঘটে নার্সারি বিপ্লব। এলাকায় তিন শতাধিক নার্সারি গড়ার কারিগর তিনি। সবুজ বপ্লবের অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
আবদুল মান্নান পেশায় শিক্ষক ছিলেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ এমএইচ ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে দুর্লভ জাতের গাছগাছালির চারা সংগ্রহ করতেন। তাঁর সংগ্রহ করা দুর্লভ হরেক জাতের বিদেশি গাছগাছালি শোভা পাচ্ছে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া সেনানিবাস, সরকারি আজিজুল হক কলেজ ক্যাম্পাস, কুমিল্লার বার্ডসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বগুড়া থেকে চারা ও মাটি নিয়ে গিয়ে নিজ হাতে তিনি বৃক্ষরোপণ করতেন। তাঁর নার্সারিতে রয়েছে দুর্লভ কয়েক শ বিদেশি জাতের গাছ। রয়েছে বিশাল আয়তনের ভেষজ বাগান। তবে এসব ছাপিয়ে তাঁর বেশি পরিচয় ছিল প্রতœ গবেষক হিসেবেই। মহাস্থানগড়ের পাদদেশে জন্মভিটা হওয়ার কারণে শৈশব থেকেই প্রতত্নবস্তু সংগ্রহ করতেন আবদুল মান্নান। ব্যক্তিগত উদ্যোগে জাদুঘর গড়ে তোলার ইচ্ছা থেকেই ৪২ বছর ধরে দেশের মাঠঘাট, পথপ্রান্ত ঘুরে সংগ্রহ করেন দুর্লভ ২ হাজার ৬০০ প্রতœসামগ্রী। ইতিহাস-ঐতিহ্যের খোঁজে পথ থেকে পথে ছুটেছেন। যেখানেই প্রতত্ননিদর্শনের খবর পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে গিয়ে তা সংগ্রহ করেছেন। পুঁতির দানা থেকে প্রাচীন আমলের পণ্যবিনিময়ে ব্যবহৃত কড়ি, মৃৎসামগ্রী, তামা, পিতল ও ব্রোঞ্জের তৈজস; খাট-পালঙ্ক, দরজা-কপাট—এসব সামগ্রী সংগ্রহ করেন তিনি দিনের পর দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করা আবদুল মান্নান পূর্ন্ড্রবর্ধনের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণাধর্মী বই ‘ইতিকথা পূর্ন্ড্রবর্ধনের লিখেছেন। সবুজ নার্সারির মাধ্যমে এবং তার কর্মপ্রচেষ্টায় স্বপ্ন দেখিয়েছেন নিজের এলাকার এবং অন্যান্য জেলার হাজার হাজার বেকারদের যারা আজ সফল নার্সারি মালিক। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন মহল শোক প্রকাশ করেছেন।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ