ভবদহে ৮০৮ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ ভবদহ যশোর-খুলনার বিরাট এলাকার দীর্ঘুদিনের অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের নামে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামকস্থানে শ্রীনদীর উপর নির্মাণ করা হয় একটি বড় স্লুইস গেট। একপর্যায়ে যশোর ও খুলনার প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ১০ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষের মরণ ফাঁদে পরিণত হয় ওই স্লুইস গেটটি। গেট সংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী এই ৩টি নদী রয়েছে। স্লুইস গেট দিয়ে বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশেপাশের শত শত গ্রামে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে রূপ নেয় ভয়াবহতায়। ভবদহের কারণে বছরের পর বছর ধরে বহু কৃষক মৎসজীবি হয়েছেন। অগণিত গাছপালা মরে গেছে। বাড়ী-ঘর, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির, হাট-বাজার ও আবাদী জমির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। ঘটে জীব-বৈচিত্রের পরিবর্তন। ক্ষতিগ্রস্তদের কথা এই, ‘আমাদের সমস্যা দেখে সরকার অর্থ বরাদ্দ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টরা লুটপাট করে। সর্বনাশ হয় আমাদের।’

অভিযোগ, যুগ যুগ ধরে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করে অর্থ লোপাটের কারখানা বানানো হয়। সমস্যা জিইয়ে রেখে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, ড্রেজিং ও টিআরএমসহ নানামুখী পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আর সরকারী অর্থ ব্যয় দেখানো হয়। যার জন্য করা হয় না স্থায়ী সমাধানের কোন মাস্টারপ্লান। নামকাওয়াস্তে সিংহভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের আশীর্বাদ। ১৯৮২ সালে দুই কোটি টাকার একটি ছোট প্রকল্প থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৭টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। অথচ সমস্যা সেই গোড়াতেই রয়ে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার জানান, সর্বশেষ চলতি বছর সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সমীক্ষা চলছে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে পাসের জন্য পেশ করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমস্যার সমাধান হবে। এতদিনের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তাতে কেন সমস্যার সমাধান হয়নি-এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তিনি। বলেছেন এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে কোন সময় কি হয়েছে তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, ভবদহ সমস্যা জিইয়ে রেখে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করে অর্থ লোপাটের কারখানায় পরিণত করেছে। তার মতে,স্লুইস গেটটি তুলে দিতে হবে। ভবদহের ২১ ও ৯ ভেন্টের মাঝখান দিয়ে নদী সংযোগ, বিল কপালিয়াসহ পর্যায়ক্রমে সব বিলে টিআরএম চালু ও উজানে নদী সংযোগ বিশেষ করে ভৈরবের সাথে মুক্তেশ্বরীর সংযোগ স্থাপন করলে ভবদহের স্থায়ী সমাধান হবে। তার মতে, এখনই বিল কপালিয়ায় টিআরএম চালু করা না গেলে ভবদহ স্লুইস গেটের মুখ থেকে শ্রীনদীর ৬০ কিলোমিটারে পলি ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন সম্পুর্ণ বন্ধ হয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। তখন নদী কেটেও শিবসা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পানি নিষ্কাশনের কোন উপায় থাকবে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারীসহ বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে ১৯৮২ সালে টেকা নদী খননে দুই কোটি টাকা, ১৯৮৭সালে শ্রীনদী খননে পাঁচ কোটি টাকা, ১৯৯০সালে ড্রেজিংএ ১৬ কোটি, ১৯৯৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরী সহায়তায় যশোর-খুলনা পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি) সবচেয়ে বড় ব্যয় ২৫৭ কোটি টাকা, ২০০০ সালে মুক্তেশ্বরী নদীর নেবুগাতি থেকে টেকা নদীর বয়ারঘাটা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার ভেড়ি বাঁধ নির্মাণে ৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ২০০৫ সালে টেকা নদীর ৫৮০ ফুট চওড়া ভাগ করে মাঝখান দিয়ে ১৩০ ফুটের নদী খনন প্রকল্পে ৮ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। ২০০৭ সালে নদী খনন, টিআরএম ও ডেজিংএ প্রকল্পে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ হয়। যার মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মোট ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এই একটিবার প্রকল্পের বাকি টাকা ফেরত যায়। বাকি প্রকল্পের টাকা ফেরতের নজীর নেই, বরং অনেক প্রকল্পের ব্যয় বর্ধিত হয়। ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অল্পদিনের মধ্যে ভবদহের টেকা নদীতে ড্রেজিংএর মাধ্যমে পানিবদ্ধতার নিরসন হয়। পানিবদ্ধ এলাকায় কৃষকরা আবার চাষাবাদ করার সুযোগ পায়। কিন্তু পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি। যে জন্য ভবদহের পরিস্থিতি আবার আগের দশায় ফিরেছে।

ভবদহের সমস্যার শুরু থেকে বছরের পর বছর ধরে প্রকৃতঅর্থে কত টাকা ব্যয় কিংবা কিভাবে কত ব্যয় দেখানো হয়েছে। তা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টীমের মাধ্যমে জনসমক্ষে রিপোর্ট প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
প্রধানমন্ত্রী কাছে স্মারকলিপি পেশ
যশোরের ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পাঠানো হয়েছে।
বিগত ৯ আগস্ট জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি পাঠানো হয়।
স্মারকলিপিতে সম্প্রতি এই এলাকার জন্য ৮০৮ কোটি টাকার ‘লুটপাটের’ প্রকল্প প্রস্তাবনা বাতিল করে ২০১৭ সালে গৃহীত বাস্তবমুখী টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়।
ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটি স্মারলিপি দেওয়ার আগে জেলা প্রশাসন চত্বরে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে। সংগঠনটির আহ্বায়ক রনজিৎ বাওয়ালীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, উপদেষ্টা অ্যাড. আবুল হোসেন, হাচিনুর রহমান, জিল্লুর রহমান ভিটু, তসলিম-উর-রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল হামিদ, সদস্য সচিব চৈতন্য পাল, সদস্য নিজাম উদ্দিন, কানু বিশ্বাস, শিব পদ, মানব মণ্ডল, রাজু আহম্মেদ, শেখর বিশ্বাস, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ভবদহ অঞ্চলের ৫২ বিলপাড়ের ২০০ গ্রামের ১০ লক্ষাধিক মানুষকে উচ্ছেদ করে জলাভূমি করার চক্রান্ত দীর্ঘদিনের। সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে গৃহীত টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এখন জলাবদ্ধতা দূরীকরণের নামে লুটপাটের উদ্দেশ্যে ৮০৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের চক্রান্ত চলছে। এতো বড় প্রকল্প ভবদহ জনপদের মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। প্রকল্পটি গণবিরোধী। এর আগে জনপদের মানুষ জোয়ারাধার বাস্তবায়নের (টিআরএম) পক্ষে মত দেন। যার ভিত্তিতে ২০১৭ সালে টিআরএম প্রকল্প গৃহীত হয়। সেই প্রকল্প বাতিল করে ৮০৮ কোটি টাকার ‘লুটপাট আর ভাগবাটোয়ারার’ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই অঞ্চলের ১০ লক্ষাধিক মানুষ জনপদ থেকে উচ্ছেদ হবেন। তাই এই গণবিরোধী প্রকল্পের ভাবনা বাদ দিয়ে দ্রুত টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানানো হচ্ছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ভারী বৃষ্টিপাত হলেই এলাকার প্রায় ২০০টি গ্রাম তলিয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১০ লাখ মানুষ। কেশবপুর, মণিরামপুর, অভয়নগর উপজেলা শুধু নয় সদর উপজেলা ও শহরের এক অংশ এবং সেনানিবাস পর্যন্ত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে বিল বোকর, কেদারিয়া, কপালিয়াসহ অন্য বিলগুলোতে পানি থই থই করছে। ডুমুরতলা, সুজাতপুর, ডহর মশিয়াহাটি, হাটগাছা, নেবুগাতি,বেদভিটা, বলারাবাদসহ অনেক গ্রামের বাড়িতে পানি উঠেছে। এ সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। অপরদিকে নদী শুকিয়ে গেছে। ভবদহ স্লুইসগেট থেকে বারো আউড়িয়া মোহনা পর্যন্ত ৫০-৬০ কিলোমিটার বিপদজনকভাবে ভরাট হয়ে গেছে। সরকার, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার অবহিত এবং বিক্ষোভ করেও কাজ হয়নি। যথা সময়ে কপালিয়া ও অন্যান্য বিলে টিআরএম চালু করলে এই পরিস্থিতি হতো না।
স্মারকিলিপিতে বলা হয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভ্রান্তনীতি ও দুর্নীতি লুটপাটের কারণে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ভবদহ অঞ্চলের মানুষ মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জলাবদ্ধতা মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই জনপদকে কেন্দ্র করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদারসহ একটি স্বার্থবাদী চক্রের অবৈধ অর্থ উপার্জনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। ক্রুগ মিশনের পরামর্শে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাকিস্তানী আমলের পানি নীতি বাংলাদেশ আমলেও অব্যাহত রাখা হয়েছে। যে নীতি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ, নদী পানি ব্যবস্থাপনা, জীব বৈচিত্র ও জীবন যাত্রা প্রনালী বিপর্যস্ত করে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে। ভবদহ স্লুইসগেটের মাধ্যমে নদীকে হত্যা করা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৬ সালে আপনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার টিআরএম প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার মধ্যে দিয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয় এবং বিল খুকশিয়ায় এর সফলতা ও পর্যায়ক্রমে অপরাপর বিলে চালু করার প্রশ্নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলে এবং বিল কপালিয়ায় কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে টিআরএম এ বাধা এবং প্রকল্প বাতিল করা হয়। সে ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) এর উদ্যোগে পানিসম্পদমন্ত্রী স্থানীয় নির্বাচিত সদস্যবর্গ আন্দোলনকারী সংগঠনের উপস্থিতিতে এক জাতীয় কর্মশালায় বিল কপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প চালুর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই লুটেরা চক্রের ষড়যন্ত্রে খোঁড়া যুক্তিতে যাচাই বাছাই কমিটিতে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। সে এখতিয়ার ওই কমিটির আছে কি না সেটি প্রশ্ন। নতুন করে এই অঞ্চলের স্বার্থ বিরোধী ৮০৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও জনমত সমীক্ষার নীতিমালা না মেনে জনমতকে উপেক্ষা করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্প উত্থাপন করেছে, যা সরকারি নীতিমালার চরম লঙ্ঘন।
স্মারকলিপিতে ৮০৮ কোটি টাকার গণস্বার্থ বিরোধী প্রকল্প বাতিল করে ২০১৭ সালের গৃহীত বিল কপালিয়াসহ অপরাপর বিলে টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ