মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস (রোকেয়া দিবস) উপলক্ষে বগুড়ায় সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত।

বগুড়া প্রতিনিধিঃ মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু দিবস (রোকেয়া দিবস) উপলক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম বগুড়া জেলা শাখার উদ্যোগে আজ ০৯ডিসেম্বর ২০২০ বেলা: ১২:০০ টায় বগুড়া শহরের প্রধান প্রধান সড়কে র‌্যালি শেষে সংগঠন কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের জেলা আহবায়ক দিলরুবা নূরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ বগুড়া জেলা আহŸায়ক কমরেড এ্যাড.সাইফুল ইসলাম পল্টু, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম জেলা সদস্য রাধা রাণী বর্মন, রেনু বালা, আখলিমা খাতুন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জেলা স্কুল বিষয়ক সম্পাদক রিতু খাতুন, সদস্য পূজা প্রামানিক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

আলোচনা সভায় সাইফুল ইসলাম পল্টু বলেন- নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া এই উপমহাদেশের নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজও পরিপুর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। সময়ের পরিবর্তনে নারীকে ভিন্নভাবে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন দিন দিন বাড়ছে, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে নারীকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সম্পত্তিতে আজও নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারী যে মানুষ হিসাবে সমাজে পুরুষের পাশাপাশি সমান ভুমিকা রাখতে পারেন এই পুজিঁবাদী ভোগবাদী মুনাফার সমাজব্যবস্থা তা অস্বীকার করে এবং নারীকে মানুষ হিসাবে মেনে নিতে চায় না। যে সমাজে অর্ধেক নারী সেখানে নারী মুক্তি ছাড়া সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সমাজের অগ্রগতি ও নারীমুক্তির জন্য এই পুজিঁবাদী-ভোগবাদী সমাজ ভাঙ্গা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নারী-পুরুষ সকলকে সমভাবে যুক্ত হওয়ার আহবান জানান।

আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্য দিলরুবা নূরী বলেন- বেগম রোকেয়া বাংলাদেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ। সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, নারীর সামনে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার সাহস, যুক্তি ও আপন প্রত্যয় নিমার্ণের লক্ষ্যে আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, সংগঠন গড়ে তুলেছেন। বেগম রোকেয়া সমাজে নারীর যে অবস্থান দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর ৮৬ বছর পরও আমরা তার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারিনি। বাহ্যিকভাবে হয়তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে বলে বোধ হবে; নারী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হচ্ছেন। কিন্তু সমাজ মননে যেন আরও অবক্ষয় ঘটে গেছে।

আলোচনা সভায় রাধা রাণী বর্মন বলেন – সারাদেশে নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন-হত্যা এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাহাড়ে বা সমতলে, ঘরে-পথে-স্কুলে-কারখানায় যেকোন স্থানে; দিনে বা রাতে যেকোন সময়ে বাংলাদেশে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, বন্দি করে রেখে গণধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন-হত্যা, বখাটেদের উৎপীড়ন, গণপরিবহনে যৌন হয়রানি, ইন্টারনেটে বøাকমেইলসহ ঘরে বাইরে নানা উৎপীড়ন, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে উৎকণ্ঠার বাইরে কোনো নারীর পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন কল্পনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কতভাবে যে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটানো হচ্ছে! কিন্তু অপরাধীরা বরাবরের মতোই ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে বিচারের হাত থেকে। আর এই বিচারহীনতার রেওয়াজ দিন দিন নারী নির্যাতনকে বাড়িয়ে চলেছে।

আলোচনা সভায় অন্যন্য নেতৃবৃন্দ বলেন স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও বাংলাদেশের আইনে নারী সমানাধিকার পান না। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনে নারী বৈষম্যের শিকার হন। সমকাজে সমমজুরি আইনে থাকলেও; বাস্তবে প্রায় সমস্ত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারী, পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে থাকেন। নারীরা দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৪৫ ধরনের কাজ করেন। পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রায় সাড়ে ৩ গুণ কাজ বেশি করেন। কিন্তু নারীর গৃহস্থালির কাজের আর্থিক মূল্য এখনও জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এখনও এমন যে সন্তান লালন-পালনসহ পারিবার ও ঘর-গৃহস্থালির কাজের দায়িত্ব নারীর। নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের তেমন কোন উদ্যোগ নেই। বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমায় নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করা হয়। পর্নোগ্রাফি ও মাদক বন্ধে সরকারের কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। মহিয়সী নারীদের জীবন ও কর্ম, বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা পাঠ্যবইয়ে অন্তভূক্তকরণ বা রাষ্ট্র ও সমাজে তেমন মূল্যায়িত হয় না। অন্যদিকে ওয়াজ-মাহফিলে নারীকে নিয়ে অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ফতোয়া দিয়ে নারীর উপর অত্যাচার করা হয়। এই নির্মম বাস্তবতা ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তনে, সমাজের সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, নারীমুক্তির আন্দোলনে বেগম রোকেয়া আজও প্রেরণার উৎস। বেগম রোকেয়ার সেই আহŸান ‘জাগো গো ভগিনী!’ কে ধারণ করে , সমস্ত শোষণ, নির্যাতন, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই; নারী-পুরুষের মিলিত সংগ্রাম গড়ে তুলি; মনুষ্যত্ব, সভ্যতা, স্বাধীনতা ও মানবতার দাবি আদায় করি এই আহŸান জানান।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ