হিন্দু নয়, নতুন ধর্মের স্বীকৃতি চায় ভারতের আদিবাসীরা

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আদিবাসী সমাজের জন্য একটি পৃথক ধর্মের স্বীকৃতি চেয়ে বিধানসভায় সম্প্রতি একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ওই ধর্মটির নামকরণ করা হয়েছে সার্না। ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মাচরণের রীতিতে কিছু কিছু ফারাক আছে, তবে তারা মূলত প্রকৃতি পূজারী। আদিবাসী সমাজ বলছে, আগে জনগণনার সময়ে তারা নিজেদের ধর্ম উল্লেখ করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে শুধুই হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ইত্যাদি প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যেই একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হন তারা। এই প্রথা বদলের দাবি ঝাড়খণ্ড রাজ্যে দীর্ঘদিন থেকেই উঠছে।

ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের আনা ওই প্রস্তাবটি যদি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেয়, তাহলে আগামী বছরের জনগণনা ফর্মে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি প্রধান ধর্মের সঙ্গে সার্না ধর্মের নামও উল্লেখ করা থাকবে।

অন্যদিকে আদিবাসী সমাজ আসলে সনাতন হিন্দু ধর্মেরই অনুসারী বলে মনে করে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি-র মিত্র আরএসএস। আদিবাসী সমাজের অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে বা তারা হয়তো কিছু কিছু হিন্দু রেওয়াজও পালন করে। তবে আদিবাসীদের ধর্মগুরু বন্ধন টিগ্গা বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরে তারা যে ধর্ম পালন করেন সেটি আসলে প্রকৃতির আরাধনা। বন্ধন টিগ্গার ভাষায়, ‘ভারতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন আর বৌদ্ধ; এই ছয়টি ধর্ম দিয়েই জনগণনার সময়ে নাগরিকদের পরিচিতি নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু এর বাইরেও আমরা তপশিলভুক্ত জনজাতি, অর্থাৎ আদিবাসীরাও ভারতের বাসিন্দা। কিন্তু আমাদের কোনও ধর্মীয় পরিচিতি লেখা থাকে না। আমরা প্রকৃতির পূজারী; যে ধর্মের নাম সার্না।’

তিনি বলেন, আগামী বছরের জনগণনায় যাতে পৃথক সার্না ধর্ম উল্লেখ করার সুযোগ থাকে, সেটাই চাইছে আদিবাসী সমাজ বন্ধন টিগ্গার ভাষায়, ‘ভগবান ধর্মেশ, সিংবোঙ্গা, হিল্লা মারাংবুরুর উপাসনা যারা করে, তারাই সার্না ধর্মাবলম্বী। সার্নার আরেক নাম হল সৃষ্টি। পানি, বায়ু, অগ্নি, ভূমি এবং আকাশ; এই পাঁচটি মূল উপাদানের মাধ্যমে যে সৃষ্টি, তারই উপাসক আমরা। তিনি জানান, যে উপাসনাস্থলে প্রকৃতিরূপী ভগবানকে আদিবাসী মানুষ অনুভব করেন সেটাই সার্না।

সার্না শব্দটি ওঁরাও জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। উপাসনাস্থল বোঝাতে কিন্তু সাঁওতাল, হো, মুন্ডারি ইত্যাদি জনজাতির ভাষায় উপাসনাস্থলের আলাদা নাম রয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা অবশ্য মনে করে না যে, আদিবাসীদের পৃথক কোনও ধর্ম আছে। তারাও সনাতন হিন্দু ধর্মেরই অংশ বলেই মনে করে আরএসএস।

আরএসএস-এর শাখা সংগঠন বনবাসী কল্যাণ আশ্রম দীর্ঘদিন ধরেই আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে কাজ করে। এছাড়াও জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চও রয়েছে আদিবাসীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার জন্য। জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চের জাতীয় সহ-কোঅর্ডিনেটর রাজকিশোর হাঁসদার গবেষণার বিষয় ছিল সাঁওতালি ও হিন্দু সংস্কৃতির তুলনা।

তিনি বলেন, সার্না ধর্ম বলে আলাদা কিছু হয় না। এটা আদিবাসীদের একটা অংশের পূজার জায়গা। অনাদিবাসী মানুষরাও যেমন কুর্মী, কৈরী, এরাও সার্নাস্থলকে মান্য করেন।বন্ধন টিগ্গার ভাষায়, ‘আসলে আদিবাসীরাও সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীই। আমার পিএইচডি গবেষণার সময়ে বহু উদাহরণ পেয়েছি আমি।’

তাদের ধর্মাচরণকে কোনওভাবেই হিন্দু ধর্ম থেকে পৃথক করা যায় না বলে মনে করেন হাঁসদা। তিনি বলেন, সাঁওতালি সমাজ নিয়ে গবেষণার সময় তিনি জানতে পেরেছেন, তারা প্রায় ৯৫ শতাংশই হিন্দু রীতিনীতি মেনে চলে। রাজকুমার হাঁসদা-র ভাষায়, ‘তাদের নামকরণেও রাম, শিব, লক্ষণ, সীতা- এসব নাম পাওয়া যায়। সাঁওতালিদের বিয়ের আসরে লোমতা আর বাওবরে দেখা যায়- এই দুটো হচ্ছে রামায়ণে বর্ণিত ব্রাহ্মণ ও বিশ্বামিত্র মুনির প্রতীক। মহাভারতে ভীষ্ম যেমন শরশয্যায় শুয়েছিলেন, সে রকমই একটা রীতি আছে শোহরাই পরবে। যারা বলছে যে, আদিবাসীরা শুধুই প্রকৃতি পূজারী- সনাতন হিন্দু ধর্মের আধারও তো প্রকৃতিই।’

তার অভিযোগ, সার্না ধর্মের নামে রাজনীতি তো হচ্ছেই। এছাড়াও এটা একটা বড় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এর সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারি ও বামপন্থীরা জড়িত। আদিবাসী ধর্মগুরু বন্ধন টিগ্গার কাছে যখন আরএসএস এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলোর এই ব্যাখ্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়, তিনি প্রথমেই একটা গান গেয়ে এর উত্তর ব্যাখ্যা করতে চাইলেন।

গানটি এমন, ‘সিন্ধু ঘাটিরে বাবা রে রিয়াএ লা, মহনজুদরো হরপা ঘাটিরে বাবা রে রিয়এ লা…।’ এই গানের অর্থ হলো কোথা থেকে আর্তচিৎকার আর কান্নার শব্দ আসছে- সিন্ধু উপত্যকা, মহেনজোদারো, হরপ্পা উপত্যকা থেকে আসছে ওই কান্নার রোল। হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসী সমাজ সিন্ধু উপত্যকার কান্না নিয়ে প্রচলিত গানটি গেয়ে থাকে। অনার্য সিন্ধু সভ্যতার ওপরে আর্যদের আক্রমণ এবং যুদ্ধের কথাই বলা হয়েছে ওই গানে।

বন্ধন টিগ্গার প্রশ্ন, ‘আদিবাসীরা যদি সনাতনী হিন্দুই হবে, তাহলে কেন মধ্য এশিয়া থেকে আগত আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের যুদ্ধ হয়েছিল সিন্ধু উপত্যকায়? এছাড়াও জন্ম-বিয়ে-মৃত্যু জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই হিন্দুদের সঙ্গে আদিবাসীদের অমিল রয়েছে। যেমন হিন্দুদের মৃত্যু হলে দাহ করা হয়, কিন্তু আদিবাসীদের দাফন করা হয়। তার ভাষায়, ‘তবে কেউ যদি মৃত্যুর পরে দাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন, তাকে অবশ্য দাহই করা হয়। জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই আমাদের ধর্মাচরণের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের মিল নেই।’

আদিবাসীদের পৃথক ধর্ম বলে কিছু নেই বলে মনে করছে আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলো। তবে ঝাড়খণ্ডের সাহিত্যিক ভন্দনা টেটে মনে করেন, আদিবাসীরা চিরকালই প্রকৃতির আরাধনা করে এসেছে। তবে আরএসএস-ই আদিবাসী সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে হিন্দু ধর্মের রীতি-নীতি, আচার-আচরণের প্রবেশ করিয়েছে। সাহিত্যিক ভন্দনা টেটে-এর ভাষায়, ‘দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী সমাজের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের কাজ করছে আরএসএস। হিন্দু ধর্মের প্রেক্ষিতে ভালো-মন্দের ভাবনাটা আদিবাসীদের মাথায় তারাই ঢুকিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যেমন আমরা গরুর মাংস খাই। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরাই এটা বোঝাতে থাকে যে গরুকে তো মা হিসাবে মানা হয়, তাহলে কী করে গরুর মাংস খাওয়া যেতে পারে? এছাড়াও অনেক জায়গাতেই দারোম, অর্থাৎ রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী গরু, মহিষ শূকর, মুরগী এসব উৎসর্গ করা হয়। আরএসএস-ই আদিবাসীদের একটা অংশকে ব্রেনওয়াশ করে বোঝায় যে এটা অনুচিত।’

তিনি বলেন, ‘একদিকে হিন্দুরা বলে আমরাও নাকি তাদের ধর্মের। অথচ এখনও আদিবাসীদের অসুর-রাক্ষস-বর্বর ইত্যাদি বলা হয়। হিন্দু ধর্মে আদিবাসীদের ছোট করে দেখানো হয়।’ প্রস্তাব পাস হয়ে গেলেও আদিবাসীদের এই ধর্মের যে নাম দেওয়া হয়েছে সার্না; তা নিয়ে আদিবাসী সমাজের মধ্যেই মতান্তর রয়েছে।

সমাজকর্মী অলোকা কুজুর বলেন, ‘সার্না শব্দের অর্থ হল শাল গাছ। এটা ওঁরাও জনজাতির ভাষা কুরুক শব্দ। সব আদিবাসী কিন্তু সার্না শব্দটাকে মেনে নেয় না। ঝাড়খণ্ডেই সার্না নিয়ে তিনটা ভাগ রয়েছে। যদি এটাকে আদিবাসী ধর্ম বলে অভিহিত করা হতো, তাহলে হয়তো যথার্থ হতো। অলোকা কুজুর বলেন, ‌‘শুধু ওঁরাও জনজাতির উপাসনাস্থলকে সব আদিবাসীর ধর্ম বলাটা ঠিক হয়নি। প্রত্যেকটা জনজাতির পৃথক নামে উপাসনাস্থল রয়েছে। তারা কি সার্না ধর্ম মেনে নেবে?

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ