খুলনা-৬ আসনে আ.লীগ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীর ছড়াছড়ি

খুলনা প্রতিনিধি: চলতি নভেম্বর মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা ও আগামী বছরের প্রথমে নির্বাচন। এরই মধ্যে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা জাতীয় সংসদীয় আসন ১০৪, খুলনা-৬ আসনে (কয়রা-পাইকগাছা) বইছে ভোটের হাওয়া। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো রয়েছে সরকার পতনের আন্দোলনে। তবে অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছড়াছড়ি।

সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌঁড়ঝাপ চলছে গোটা নির্বাচনী এলাকায়। চলছে কাঁদা ছোড়াছুড়াড়ি। এর মধ্যে প্রতিপক্ষের পোস্টার ছেড়া, আবার সে ঘটনায় জিডির ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচনী এলাকায় ঘন ঘন ছুটছেন দলের হেভিওয়েট নেতারা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এক ডজনের বেশি কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আ.লীগ নেতা। এ সকল নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তৃণমূলে জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে রয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আঁটঘাট বেঁধেই মাঠে নেমেছেন।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খুলনা-৬ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ভোটের আগে মাঠের লড়াইয়ে দলীয় পর্যায়ে লবিং গ্রুপিং এর পাশাপাশি নিজ নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে তৃণমূলে গণসংযোগ শুরু করেছেন প্রার্থীরা। দলের সবুজ সংকেত পেতে অব্যাহত চেষ্টা চলছে তাদের। আসনটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য ২০১৮ সালে নির্বাচিত আক্তারুজ্জামান বাবুর পাশাপাশি সরকার দলীয় অন্তত এক ডজন সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়মিত মাঠে গণসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, উৎসব ও দলীয় কর্মসূচীতে নিজেদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা ও ব্যানার-পোষ্টারের মাধ্যমে নিজেদের মনোনয়ন প্রত্যাশার বিষয়টি জানান দিচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাড. শেখ মো. নুরুল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই আসনের সংসদ সদস্য হন আ.লীগ নেতা সোহরাব আলী সানা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এবং ঘূর্ণিঝড় আইলা উপকূলীয় এলাকার বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম,স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ উঠতে থাকে তার বিরুদ্ধে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হন। জেলার এই প্রবীণ নেতা পুনারায় এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শেখ মো. নুরুল হক। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। পাইকগাছা উপজেলায় বিরোধপূর্ণ ৫০ শতক জমির চারপাশে উঁচু দেয়াল তুলে দেন সংসদ সদস্য নূরুল হকের লোকজন। তাতে ওই দেওয়ালের ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সেখানে বসবাসকারী আব্দুল আজিজ গোলদারের পরিবার। তারা দীর্ঘদিন ধরে মই লাগিয়ে দেওয়ালের ওপর দিয়ে এবং গর্ত খুঁড়ে দেওয়ালের নিচ দিয়ে চলাচল করতে থাকেন। যা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায়ও প্রচারিত হয়। তৈরি হয় তোলপাড়। এমনকি দলীয় সভাতেও নুরুল হককে ভৎর্সনা করা হয়। পরে ওই দেওয়াল উদ্বোতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভেঙ্গে দেয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট ফখরুল আলম।

এছাড়া তার ছেলে শেখ মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ও এলাকায় ইটভাটা দখলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল হকের মৃত্যুর পর তার দু’পুত্র জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শেখ মনিরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক শেখ রাশেদুল ইসলাম মনোনয়ন পেতে মাঠে আছেন। উল্লেখ্য, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গত উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার অভিযোগ আছে শেখ মনিরুল ইসলামের বিরদ্ধে। অন্যদিকে শেখ রাশেদুল ইসলাম নারী কেলেংকারী ঘটিত মামলা করে নিজেই হয়েছেন সমালোচিত। এদিকে দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ চাইছে প্রার্থী পরিবর্তন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা পাইকগাছা-কয়রার সস্তানদের যে কাউকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। বর্তমান ও সাবেক এমপির ইমেজ সংকটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বেড়েছে দলের তরুন নেতাদের। কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম মহসিন রেজা সম্প্রতি মাঠে নামায় নেতা কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কয়রা উপজেলায় আ.লীগ-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ছিলেন জিএম মহসিন রেজা। আইলার টাকা নিয়ে দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অনাস্থা আনলে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত হন তিনি। কিন্তু পরে তাকেই আবার দল থেকে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে মনোনয়ন দেওয়া হলে বিদ্রোহী প্রার্থী শফিকুল ইসলামের কাছে পরাজিত হন তিনি। তবে চলতি বছরে জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে প্রধান বক্তা স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যকালে তার অনুসারীরা জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু স্লোগান করলে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম মহসিন রেজা উত্তেজিত হয়ে প্রধান বক্তার বক্তব্য বন্ধ করে দিয়ে সারাদেশে আলোচনার ঝড় তুলেন তিনি। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর কয়রা উপজেলা পরিষদের মাঠে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর অনুষ্ঠানে মঞ্চের ব্যানারে উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম ছিল না। এ ছাড়া সরকারের নানা ধরনের সহায়তা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির করা হয়েছে। অনুষ্ঠান বাস্তবায়নেও দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোনো প্রকার সমন্বয় করা হয়নি। এসব কারণেই অধিকাংশ নেতৃবৃন্দরা সভায় হাজির হননি। এ ছাড়া ক্ষোভের কারণে অনুষ্ঠানে হাজির হয়েও সভা মঞ্চে ওঠেননি উপজেলা আ.লীগের সভাপতি ও সম্পাদক। কয়রা উপজেলা আ.লীগের সভাপতি জিএম মোহসিন রেজা বলেন, এই অনুষ্ঠানটি করে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। যেহেতু এলাকায় মাইকিং করে উপকারভোগীদের ভয় দেখিয়ে তাদের আনা হয়েছে। বলা হয়েছে অনুষ্ঠানে না এলে সরকারের সকল সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সুন্দরবন উপকূলের দুর্গম পথ অতিক্রম করে দুস্ত গরিব অসহায় মানুষ আসতে বাধ্য করা হয়েছে। তাছাড়া আমার দলীয় কোন নেতৃবৃন্দকে জানানো হয়নি। এমনকি আমার সাধারণ সম্পাদককে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদার ও মানবিক। তিনি মানবতার মা, কোনো প্রকার বিনিময় প্রাপ্তির জন্য সহায়তা করেননি। একই ধরনের অনুষ্ঠান ১ নভেম্বর পাইকগাছা উপজেলা পরিষদে করা হয়। মনোয়ন প্রত্যাশী অন্য যে সকল নেতাদের নাম শোনা যাচ্ছে তার মধ্যে আছেন জেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার প্রেমকুমার মন্ডল। তিনি ও তার অনুসারীরা মাঠে রয়েছেন বেশ সরব। আসনটিতে দলের আরএক মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আ.লীগের কোষাধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব আলম। তিনি ২০১৬ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে আসেন জেলা আ.লীগের কমিটিতে। এলেও আ.লীগের রাজনীতিতে আগে তাকে কখনো দেখা যায়নি বলে অভিযোগ করেন দলের দ্বায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা। এছাড়া মাহবুব আলম ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। আসনটিতে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী কয়রা উপজেলা আ.লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৯-৯৫) ইউনুস সানার ছেলে, কেন্দ্রীয় আ.লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা উপ কমিটির সদস্য ও উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম সাইফুল্লাহ আল মামুন। দলের তরুন নেতা হিসাবে তিনি বেশ আলোচিত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, তিনি কোন গ্রুপিংয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। তার অনুসারীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি এলাকা ভিত্তিক উন্নয়ন ও বিভিন্ন সামাজিক, অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে এলাকার শিক্ষিত তরুণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী পছন্দের শীর্ষে রেখেছেন। মাঠে অন্যান্যদের মতো তৎপর না থাকলেও আলোচনায় আছেন কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম। অপর দিকে বিএনপি যদি নির্বাচনে যায় এবং জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে আসনটিতে জোটের প্রার্থী হতে পারেন জামায়াত নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। আর জোটবদ্ধ না হলে বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থীর ‘তালিকায় আছে, জেলা বিএনপি’র উপদেষ্টা অ্যাড. মোমরেজুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা ও সাবেক ছাত্রনেতা মো. রফিকুল ইসলাম রফিক। এছাড়া প্রার্থী হিসেবে এলাকার ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ তার বন্ধুদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন কিন্তু তিনি কোন দলের প্রার্থী তা জানা যায়নি। আর জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু ও জাপা নেতা মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীরও নির্বাচনে প্রার্থী হতে মাঠে কাজ করছেন। জেলা জাপার সভাপতি শফিকুল ইসলাম মধু নিজেকে জাপার প্রার্থী দাবি করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ জনপদে সেবা মূলক কর্মকান্ড করে চলেছি। সুখে দুঃখে সাধ্যমত মানুষের পাশে রয়েছি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জাপার মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। গত দু’বছর আগ থেকে দল তাকে ওই আসনে জাপার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে, সেভাবেই তিনি এখনও কাজ করে চলেছেন বলে জানান। বিগত সংসদ নির্বাচনে পাইকগাছা পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর, পাইকগাছা উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুল হাসান টিপু, ডা. মোহাঃ শেখ শহীদ উল্লাহ প্রার্থী হওয়ার জন্য তৎপরতা চালালেও আসন্ন নির্বাচনে তাদের দেখা যাচ্ছে না। তবে ডা. মোহাঃ শেখ শহীদ উল্লাহ নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে অসংখ্য স্থানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ফ্রী চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। এদিকে ইসলামী আন্দোলনের খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক আসাদুল আল গালিব, জাকের পার্টির আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজু নিব সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদুজ্জামান মোড়ল ও জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপকর্ াচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ