আমি করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর যন্ত্রণা দেখেছি

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বৃটিশ একজন ডাক্তারের। এমন অভিজ্ঞতা শুধু তার একার নয়, এ পেশায় যারা আছেন, যারা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন তাদের সবার। ওই ডাক্তার বলেছেন, আমার চোখের সামনে হাসফাঁস করছেন একজন রোগী। তার ফুসফুস টানতে পারছে না অক্সিজেন। গড় গড় শব্দ হচ্ছে। চোখের সামনে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন ওই রোগী। ছাটাতে ছাটাতে মারা যাচ্ছেন। এমন দৃশ্য দেখে তিনি হতাশাগ্রস্ত।

এমনই একজন ডাক্তার তার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন লন্ডনের অনলাইন ডেইলি মেইলে। নাম প্রকাশ না করে তিনি লিখেছেন, আপনি কি কখনো কাউকে তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে দেখেছেন? না, হয়তো অনেকেই তা দেখেননি। কিন্তু যারা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারা যে ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছেন হয়তো তারা তা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। গত সপ্তাহে আমার চোখের সামনে যাদেরকে মরে যেতে দেখেছি, আশা করি একদিন তাদেরকে ভুলে যেতে পারবো।

করোনায় আক্রান্তদের প্রত্যেকের মুখে অসহনীয় বেদনা। তারা অক্সিজেন নেয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। ফুসফুস সাপোর্ট দিচ্ছে না। তাদের মুখ থেকে বিকট শব্দ বেরিয়ে আসছে। এমন অবস্থায় একজন রোগীকে ফেলে কেউ যেতে পারেন না। এক দশকেরও বেশি সময় আমি বৃটিশ জাতীয় স্বাস্থ্য স্কিমের একজন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ সময়ে আমার মনে হয়েছে, যা দেখার ছিল তার সবই দেখেছি। কিন্তু করোনা ভাইরাস যে ভয়াবহতার প্রকাশ ঘটিয়েছে তার জন্য আমি কখনো প্রস্তুত ছিলাম না।

শনিবার মধ্যাহ্নভোজের সামান্য পরের ঘটনা। তখনই শুরু হয় এক ভয়াবহতা। আমার পেজার-এ সাইরেন বেজে উঠলো। আমাকে বলা হলো, একজন রোগীর শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়ে যাচ্ছে। আমি হাসপাতালের ভিতর দিয়ে দৌড়ালাম। ৭০-এর কোটায় বয়স এমন একজন রোগীকে দেখতে এমন ছোটা আমার। তিনি করোনা আক্রান্ত। গিয়ে দেখি, তার হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে গেছে। আমি গিয়ে যা দেখলাম তা হলো এক ভয়াবহ আতঙ্ক। আমার স্টাফদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। তবু এ ঘটনা কিভাবে বর্ণনা করবে তা নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। এ থেকে এখনই ইঙ্গিত মেলে যে, করোনা সংক্রমণ চিকিৎসার জন্য আমরা কত বেশি কম প্রস্তুত। লোকটিকে পুনরুজ্জীবিত করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ প্রমাণিত হলো।

দু’জন নার্সকে নিয়ে একজন সিনিয়র ডাক্তার ও একজন অ্যানেসথেটিস্ট ওই রোগীর দেহে অক্সিজেন প্রবেশের পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিলেন। তখন করোনা ভাইরাস আমাদের সামনে কিভাবে একজন মানুষকে কেড়ে নিল তা দেখে আমাকে শক্তিহীন মনে হয়েছে। ওই রোগীটি তার জীবনের সব শক্তি দিয়ে একটু অক্সিজেন টেনে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ সময় তার চোখে যে ভয়াবহতা, তা আমি দেখতে পেয়েছি। একই দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন উপস্থিত স্টাফরা। তারা সবাই আমার মেধাবী সহকর্মী, সম্মানিত পেশাদার। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সামনে কোনো ভয় নেই। কিন্তু এই মৃত্যুটি তাদের সামনে ভয় হয়ে এসেছে। আমি এটাও দেখতে পেয়েছি।

আমি একজন সিনিয়র মেডিকেল ডাক্তার। সব ওয়ার্ডেই সেবা দিই। লন্ডনের একটি ব্যস্ত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করি। কোনো বিরতি ছাড়া আমরা একটানা কাজ করি। দীর্ঘ শিফটে কাজ করি। কিন্তু গত শনিবারটি আমার কাছে ছিল ভিন্ন। হ্যাঁ, আমরা জানতাম এই ভাইরাসটি আসছে। কিন্তু এর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এই হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর দু’চার ঘন্টা আগে আকস্মিকভাবে আমাদেরকে বাধ্য করা হলো আমাদের ওয়ার্ডকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার উপযোগী করে নতুন করে সাজাতে। এখানে আনা হচ্ছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় বেশ কিছু রোগীকে।

আমি একজন ডাক্তার। চরম হতাশার সময়েও নিজের ভিতরকার আবেগকে চেপে রাখার প্রশিক্ষণ পেয়েছি। কিন্তু শনিবার যখন ওই ব্যক্তি মারা গেলেন আমি সেই আবেগকে এদিন আটকাতে পারিনি। আমি অব্যাহতভাবে বলে যেতে লাগলাম- হায় খোদা, এসব কি ঘটছে? আমরা জানতাম যেসব মানুষ এমন অবস্থায় তার মধ্যে এই ব্যক্তিই আমাদের এখানে প্রথম মারা গেলেন। তার মতো আরো অনেকে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন। আমার ভিতরকার শিশু জেগে উঠলো। মনে হলো, যদি আমি অন্তত তাকে বাঁচাতে পারি, তাহলে আমাদের ওয়ার্ডে যত রোগী আছেন তারা হয়তো সাহস পাবেন। কিন্তু এ কাহিনী তো জীবনের। এটা তো কোনো শিশুর সাজানো গল্প হতে পারে না। ওই রোগী আকস্মিকভাবে যখন চলে গেলেন, আমার হৃদয়টা যেন ভেঙেচুরে গেল।
উৎস:অনলাইন ডেইলি মেইলে

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ