গোবিন্দগঞ্জে বেপরোয়া বালু সিন্ডিকেট!

গোবিন্দগঞ্জ প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু দখল-দূষণের কারণে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। নদী দখল-দূষণে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা মানছেন না।

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সকল নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে উপজেলার করতোয়া (কাটাখালী) নদীতে বালুদস্যুদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। নদীতে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও কৃষকের ফসলি মাঠ। এসব বিষয়ে একাধিকবার বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগিরা।

ওইসব বালুদস্যুদের তথ্য সংগ্রহ করতে সরেজমিনে গেলে অনেকে ফোন ধরিয়ে দেন গাইবান্ধা জেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি আলতামাসুল প্রধান শিল্পীর সাথে কথা বলার জন্য।

শিল্পী বলেন, সবাই আমাদের দলীয় লোকজন, তাই কোনো সাংবাদিক গেলে কথার বলার জন্য আমাকে ফোন ধরিয়ে দেন বিষয়টি দেখার জন্য।

অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করা জন্য শিল্পী ওইসব বালুস্পট থেকে পৃথকভাবে ৫০ হাজার করে টাকা চাঁদা তুলে থাকেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, টাকা লেন দেনের বিষয়টি সঠিক নয়। দলীয় কারণে সবাই আমাকে ফোন করে সহযোগিতা চান।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের ফুলহার, সাপমারা ইউনিয়নের নরেঙ্গাবাদ মেরি, সাহেবগঞ্জ, চকরহিমাপুর, কামারপাড়া, গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের কাইয়াগঞ্জ, দরবস্ত ইউনিয়নের মাড়িয়া, পৌর এলাকার খলসি মিয়াপাড়া, বালিয়া মারি, বোয়ালিয়া, কাটাখালী ব্রীজ সংলগ্ন এলাকা, রাখালবুরুজ ধর্মপুরবাজার সংলগ্ন এলাকা, বড়দহ ব্রীজ এলাকা, তালুককানুপুর ইউনিয়নের সমসপাড়া, মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বালুয়া ও দেওয়ানতলা ব্রীজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে নদীতে প্রায় শতাধিক ড্রেজার (বোমা) মেশিন বসিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।

পরিকল্পনাহীন যত্রতত্র বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে এসব বালু উত্তোলনে নদী এলাকার বসতভিটা ও ফসলি মাঠ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে পানি দূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। বালু বহনে গ্রামীণ সড়কে অবৈধ ট্রাক্টর, মাহিন্দ্রসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করছে।

এতে করে রাস্তা ভেঙে গিয়ে খানা-খন্দের সৃষ্টি হচ্ছে। যার ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। এসব বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগিরা।

সাহেবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শামীম রেজা মন্টু অভিযোগ করে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে আমাদের এলাকার অনেক বসতবাড়ী ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু ঘটনাস্থলে প্রশাসন পৌঁছার আগেই বালুদস্যুরা খবর পেয়ে যান। প্রশাসন গিয়ে সেখানে কাউকে না পেয়ে ফেরত চলে যায়। পরে তারা আবারো আগের মতই বালু উত্তোলন করতে থাকে।

চন্ডিপুর এলাকার বাসিন্দা কামরুল ও জোবায়ের এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি।

তারা বলেন, অভিযোগ দেয়ার পর বালুদস্যুরা উল্টো আমাদেরকে মারতে আসে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বালুদস্যুদের হাতে মারধরের শিকারও হয়েছেন ভুক্তভোগিরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালিয়া এলাকার এক বালু ব্যবসায়ী বলেন, করতোয়া নদীর শতাধিক পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব নিয়ে এসব পয়েন্ট থেকে ৫০ হাজার করে টাকা চাঁদা নেন শিল্পী।

ফুলবাড়ীর ইউপির আব্দুল খালেক নামে এক ব্যক্তি প্রশাসনকে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার না পেয়ে স্থানীয় আদালতে বালুদস্যুদের নামে মামলা করেন। যা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

তালুককানুপুর ইউপির সমসপাড়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য হাফিজার রহমান বলেন, প্রশাসনের কাছে গেলে বলেন অভিযোগ দিতে। অথচ লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হয়না। বরং এলাকায় শক্রতা বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ বর্মন বলেন, রাজনৈতিক চাপও রয়েছে, তাছাড়া এলাকার উন্নয়ন করতে গেলে তাদেরকেও তো একটু সুযোগ দিতে হয়। এছাড়া বালু উত্তোলন বন্ধে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। কিছুদিন বন্ধ রাখার পর তারা আবারো উত্তোলন করছে। এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে নিয়মিত মামলা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি তা করছেন না।

থানার ওসি একেএম মেহেদী হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে উর্দ্ধতন কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন যেহেতু এটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজ সেহেতু নিয়মিত মামলা করা যাবেনা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোকলেছুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে কোনো সহযোগিতা করছেননা। এ ব্যাপারে অচিরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে অভিষ্যতে গোটা উপজেলা হুমকীর মুখে পড়বে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ