৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড গঠন

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এদিন। পদে পদে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তারা একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাক সেনাদের ফাঁদে ফেলেন। এদিনে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হলো মিত্রবাহিনী। ওইদিন গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।

যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায় গঠিত মিত্রবাহিনী, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনী  বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ সময় নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকায় যোগাযোগ পথে (রুট) বাংলাদেশে প্রবেশ করে।এতে করে যশোর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরো কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় ভাষণদানকালে ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনা ও রাডার স্টেশনগুলোতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী।এতে করে ভারতজুড়ে জারি হয় জরুরি আইন। সে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্ব।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’

এদিকে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে। গভীর রাতে পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই হানাদার বাহিনীর সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি ঘটানো হয়। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। এদিন ১১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক আফসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের কয়েকটি পর্যায় ছিলো। প্রথম পর্বটা ছিলো প্রতিরোধ পর্ব। এ নিয়ে আমার একটা বই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের প্রতিরোধ এবং অসহযোগিতা করার পর্বটি এপ্রিলে মাসের মধ্যে শেষ হয়। তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা বাংলাদেশ পুরোপুরি দখল করে নেয়।’

মুক্তিযুদ্ধের ওপর একাধিক গবেষণাধর্মী বই লেখা এই গবেষক বলেন, ‘এপ্রিলে রাজনীতিবিদরা মুজিবনগরে চলে যায় এবং মুজিব নগর সরকার গঠন করে। এই সময় গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে এবং ক্রমেই যুদ্ধ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।কিন্তু যুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবিাহিনীকে সামনাসামনি যুদ্ধে পরাজিত করার মতো শক্তি তখন ছিলো না। এটা্ মেনে নেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো।’

অফসান চৌধুরী বলেন, ‘এ অবস্থায় ভারত বাংলাদেশকে পুরোপুরি সহায়তা দিচ্ছিল।এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। আর এই জন্য আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতেরও বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় বিষয় ছিলো পাকিস্তানকে ভাঙা। বাংলাদেশ যদি স্বাধীনতার চেষ্টা না করতো, তাহলে ভারতের এ লক্ষ্য অর্জিত হতো না। সেজন্য ভারত নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। এটি ভারতের দয়ামায়ার বিষয় না। ভারত তার নিজের স্বার্থেই করেছিল।’

আফসান চৌধুরী বলেন, ‘ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত বাংলাদেশ যৌথবাহিনী গঠন করে। এ বিষয়ে মুজিবনগর নামে আমরা একটা বই রয়েছে। বইটিতে উল্লেখ করা আছে কীভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যৌথবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। যৌথবাহিনী গঠন অবধারিত ছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারত অস্ত্রশস্ত্র, টেনিং সবই দিচ্ছিল।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও সেনাবহিনীর সৈন্য হিসেবে পাকিস্তানিদের হারানোর ক্ষমতা ছিল না। কারণ একটা প্রতিষ্ঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল একটা প্রতিষ্ঠিত বাহিনী জিততে পারে। যৌথবাহিনী গঠনের মাধ্যমে সেটিই ঘটেছিল। যৌথবাহিনী গঠন করায় বাংলাদেশের বিজয় দ্রুত সময়ে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।’

আফসান চৌধুরী বলেন, ‘লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আমাকে একটা কথা বলেছিল, যেটি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়। কথাটা হলো- ‘তোমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গ্রামের মানুষ যদি সহায়তা না করত তাহলে আমরা কোনোদিনই বাংলাদেশে ঢুকতে পারতাম না।’

অতত্রব বিষয়টা কেবল সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধটা ছিলো সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে জনগণের যুদ্ধ, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল। তবে বাংলাদেশে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর লোকেরা অনেক সময় সাধারণ জনগণের ভূমিকাটা গৌণ করে ফেলে।

তিনি বলেন, ‘আবার জনগণ সঙ্গে না থাকলে শুধু যৌথবাহিনী দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না।’

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ