মেসিকে ঘিরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্জেন্টিনা

আর্জেন্টিনা এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ফুটবল দলগুলোর একটি, আর তার অন্যতম কারণও একজন ফুটবলার-লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনা যেসব ম্যাচে খেলবে, বিশ্বকাপের সেইসব ম্যাচের টিকিট ওয়েবসাইটে ছাড়ার ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর টিকিট ফুরিয়ে যায়।

এই আগ্রহ লিওনেল মেসিকে শেষ একটি বারের জন্য বিশ্বকাপের মঞ্চে মাঠে বসে দেখার, তার সমর্থকেরা দেখতে চান বর্তমান ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড়ের হাতে বিশ্বকাপের শিরোপা। আর্জেন্টিনাও অবশ্য এবারে আশা দেখাচ্ছে। লাতিন আমেরিকার এই দেশটির ফুটবলকে যারা সমর্থন করেন, তারা এক সময় বিশ্বকাপ নিয়ে আশাবাদী হয়েছেন গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, বা রিকোয়েলমে অথবা গত ১০-১৫ বছরে লিওনেল মেসিকে নিয়ে। তবে সমর্থকদের আশা পূরণ করতে পেরেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এবার আর্জেন্টিনার সমর্থকরা দলের খেলা দেখেই আশাবাদী হতে পারেন, চাইলে পরিসংখ্যানেও চোখ বুলাতে পারেন। সেই ২০১৯ সালের পর আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দল কোনো ম্যাচ হারেনি। অর্থাৎ গত ৩৫ ম্যাচে হারেনি আর্জেন্টিনা- এর মধ্যে ২৬টি ম্যাচেই জয় পেয়েছে লিওনেল মেসির দল, ৯টি ম্যাচ ড্র হয়েছে। এই তিন বছরে প্রায় ২৯ বছর ধরে অধরা থাকা শিরোপাও (কোপা আমেরিকা ২০২১) এসেছে লিওনেল মেসির টুর্নামেন্ট-সেরা পারফরম্যান্সে ভর করে।

এর আগে কখনো এতোটা স্বস্তি নিয়ে আর্জেন্টিনার কোনো ফুটবল দল বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল কি না, সেটাই ভাবছেন বোদ্ধারা।

আর্জেন্টিনার দৃশ্যপট পাল্টালেন মেসি
কোচ হোর্হে সাম্পাওলির অধীন আর্জেন্টিনার ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ লিওনেল মেসি নিজেও ভুলে যেতে চাইবেন। সমর্থকরাও মনে না রাখার চেষ্টা করবেন, বিশেষ করে যেভাবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে গোল হজম করেছিল আর্জেন্টিনা। ডি বক্সের ভেতরে আর্জেন্টিনার গোলকিপার বল পায়ে তুলে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়ান ফরোয়ার্ডের, ফলাফল গোল হজম। এরপর এক ম্যাচে সদ্যই আঠারো বছর বয়স পার করা ফরাসী সেনসেশন কিলিয়ান এমবাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনাকে রীতিমতো নাচিয়েছেন নিজের গতির তোপে।

তারপর কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন সহকারী কোচের দায়িত্বে থাকা লিওনেল স্কালোনি। সঙ্গে ছিলেন পাবলো আইমার।

স্কালোনি শুরুতে সাফল্য পাননি- অনেক সময় মনে হয়েছে তিনি দ্বিধায় রয়েছেন যে ঠিক কী করবেন। মেসি কোথায় খেলবেন, কীভাবে খেলবেন, খেলার ধরন কী হবে- এসব নিয়ে ভুগতে হয়েছে তাকে। প্রথম দফায় স্কালোনির সঙ্গে ২০১৯ সালের কোপা আমেরিকা পর্যন্ত চুক্তি বাড়ায় আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। সেবার কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা তৃতীয় হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ শক্ত করতে থাকেন স্কালোনি। লিওনেল মেসির সঙ্গে তার বোঝাপড়া যেমন ভালো হতে থাকে তেমনই অন্য পজিশনগুলোতেও দক্ষ ও পরিশ্রমী ফুটবলারের সন্ধান পেতে শুরু করেন তিনি। ফল পান ২০২১ সালে এসে – কোচ স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জেতান। তবে তার তুরুপের তাস ছিল মেসিই। সেবার ২৮ বছরের মধ্যে আর্জেন্টিনা প্রথম কোনো শিরোপা হাতে পেয়েছিল। প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল, ভেন্যু ছিল ব্রাজিলের মারাকানা, এসব কেবলই এই জয়ের মাহাত্ম্য বাড়িয়েছিল আর্জেন্টিনার জন্য।

দল নিয়ে যা করেছেন কোচ স্কালোনি
স্কালোনির প্রথম কাজ ছিল দলকে একটা ইউনিট হিসেবে খেলানো, যেখানে মেসি থাকবেন কেন্দ্রে- যেহেতু তিনিই বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন এবং দক্ষতায় তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো ফুটবলার দলে আর নেই। কিন্তু এই মেসি নির্ভরতাও এক সুতোয় গেঁথেছিলেন স্কালোনি। শুরুতেই তিনি এমন সব ফুটবলারকে দল থেকে ধীরে ধীরে বাদ দেন যাদের বয়স হয়ে গিয়েছিল। তবে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া শুরুতে তার জন্য খুব সহজ ছিল না। সমর্থন পাননি তখন তিনি। সিনিয়র ফুটবলারদের দল থেকে সরানো সব সময়েই একটা কঠিন কাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার তরুণ স্কোয়াড তৈরির প্রকল্প ফল পেল।

এখন পর্যন্ত টানা ৩৫ ম্যাচ হারেনি আর্জেন্টিনা, আর মাত্র দুই ম্যাচ অপরাজিত থাকলেই আর্জেন্টিনা রবার্তো মানচিনিরি ইতালির হার না-মানা ৩৭ ম্যাচের বিশ্ব রেকর্ড স্পর্শ করবে। লিওনেল মেসি কি প্রস্তুত?
লিওনেল মেসিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার মনে করা হয়, আর এর প্রমাণও তিনি দিয়েছেন বহুবার। সমালোচনার শিকার হয়েছেন অনেক, তবে মাঠেই জবাব দিয়েছেন আর্জেন্টিনার ‘ছোট্ট জাদুকর’। যেমন গত মৌসুমে ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে যোগ দেয়ার পর লিওনেল মেসি ঠিক ‘মেসিসুলভ’ খেলা খেলতে পারছিলেন না। তবে মেসি প্যারিসে থিতু হওয়ার প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছেন এবং পিএসজির হয়ে প্রায় নিয়মিত গোল পাচ্ছেন।

মেসিকে জানেন ও চেনেন স্প্যানিশ ফুটবল লেখক গিলেম বালাগ। বিবিসি স্পোর্টের এক কলামে তিনি লিখেছেন, ‘মেসির পরিবার ধীরে ধীরে প্যারিসকে বাড়ি মনে করছে।’ ‘মেসির স্ত্রী আন্তোনেলা কাজ করছেন প্যারিসে, তার বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, সেখানে তারা ফ্রেঞ্চ ও ইংলিশ শিখছে,’ যোগ করেন তিনি। মাঠও লিওনেল মেসি এখন আরও স্বতস্ফূর্ত, এমবাপে ও নেইমারের মতো প্রভাবশালী ফুটবলার থাকা সত্ত্বে¡ও তিনিই বল নিয়ন্ত্রণ করছেন প্যারিসে। ৩৫ বছর বয়সেও তিনি নিজেকে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিয়েছেন। চলতি মৌসুমে তার তিনটি শিরোপায় চোখ- বিশ্বকাপ সবার আগে, এরপর পিএসজির হয়ে ফরাসি লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সাফল্য যদি ধরা দেয়, তাহলে অষ্টম ব্যালন ডি অর মেসির অধরা থাকবে না। সেটা পেলে তিনি কেবল নিজেকেই ছাড়াবেন। এই আর্জেন্টাইন এবার নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলবেন। আর্জেন্টিনার হয়ে আগে এই রেকর্ড ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও হাভিয়ের মাসচেরানোর।

শুধু মেসিনির্ভর নয় আর্জেন্টিনা
তবে আর্জেন্টিনার আগের সব বিশ্বকাপ দলের সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপ দলের বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন ডিফেন্ডাররা। এবারে আর্জেন্টিনার তারকা ডিফেন্ডার আছেন, যারা ম্যাচের রঙ বদলে দিতে পারেন। রক্ষণ থেকে আক্রমণ চালাতে পারেন, প্রতিপক্ষের মানসিক অবস্থা বুঝে শারীরিক ভাষাও ব্যবহার করতে পারেন। ক্লাব ফুটবলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলেন লিজান্দ্রো মার্টিনেজ। মাঠে তার উপস্থিতিই অনন্য- সব সময় চঞ্চল এবং প্রতিপক্ষকে তিনি স্থির হতে দেন না। ডেঞ্জার জোনে বল আসার সঙ্গে সঙ্গে তা বাতিল করার প্রবণতা আছে মার্টিনেজের।

ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোও দারুণ খেলছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেন্যাম হটসপারের হয়ে। বল বানাতেও দক্ষ রোমেরো তুলনামূলকভাবে গতিশীল ফুটবলার। আর্জেন্টিনার হয়ে আর কারা মাঠ মাতাবেন?
এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দিকেও এবারে সবার নজর থাকবে। গত তিন বছরে আর্জেন্টিনার অপরাজিত থাকার পেছনে এই গোলরক্ষকের বড় ভূমিকা আছে। কোপা আমেরিকা জয়ের মিশনেও দুর্দান্ত খেলেছেন পোস্টের সামনে। একই সঙ্গে তার খেলা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। সম্প্রতি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে অ্যাস্টন ভিলার একটি ম্যাচে দেখা গেছে তিনি ফ্রি-কিক নেওয়ার সময় নিজের ক্লাব অ্যাস্টন ভিলার ফুটবলারদের পরামর্শ দিচ্ছেন যে ম্যান ইউইনাইটেড গোলকিপার ডেভিড ডি হেয়ার বল দেখার কোণ যাতে কঠিন হয় সেটা নিশ্চিত করতে।

সেই ফ্রি কিক থেকে সরাসরি গোল পেয়েছিল অ্যাস্টন ভিলা। মার্টিনেজকে ‘বাজপাখি’ ডাকেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা।

এ ছাড়া ফরোয়ার্ডে আছেন অ্যানহেল ডি মারিয়া- তার দেয়া গোলেই আর্জেন্টিনা ২৮ বছরের শিরোপা খরা ঘুচিয়েছিল ২০২১ সালে। ইতালিয়ান লিগের তারকা পাওলো দিবালাও আছেন দলে। মাঝমাঠে আছেন লিয়ান্দ্রো পারেদেজ, খেলেন তিনি ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসে। আছেন গুইদো রদ্রিগেজ, জর্মন পেজেয়া ও রদ্রিগো ডি পল। তবে ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপের দলে জায়গা পাননি জিওভানি ল সেলসো। আর্জেন্টিনার মাঝমাঠের বড় ভরসা ছিলেন তিনি। ‘আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতবে’- এমন বিশ্বাস এখন মেসি-ভক্ত এবং সামগ্রিকভাবে আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থকদের মনে জোরালোভাবেই আছে। আগামী ২২ নভেম্বর থেকে এই প্রত্যাশার প্রতিদান দেয়ার পালা বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয় টিম আর্জেন্টিনার। প্রথম ম্যাচ সৌদি আরবের বিপক্ষে। তাদের গ্রুপের বাকি দুই প্রতিপক্ষ মেক্সিকো ও পোল্যান্ড।
তথ্যসূত্র : বিবিসি

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০