আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে চলা ড্রাইভারবিহীন গাড়ির ভবিষ্যৎ কী?

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ সানফ্রানসিসকো শহরের একটি শান্ত আবাসিক এলাকায় মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ভুল করে ঠিকমতো দরজা বন্ধ না করার এক বিরক্তিকর অনুভূতি নিয়ে আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে এসেছি। অন্য সময়ে এটা নিয়ে আমি মোটেই ভাবতাম না, কিন্তু এই ট্যাক্সির রাইডটি কোনো সাধারণ রাইড না। এটি ক্রুজ কোম্পানির একটি রোবট্যাক্সি, যার দরজা ঠিকভাবে বন্ধ করার জন্য কোনো মানুষ চালক নেই।

এরপর আমি চেক করতে ফিরে গেলাম এবং দেখতে পেলাম, ঠিক তাই, ট্যাক্সির দরজাটা ঠিকমতো লাগানো হয়নি। ট্যাক্সির স্পিকার থেকে একটি মানুষের গলা শোনা গেল, সবকিছু ঠিক আছে? দরজা বন্ধ না করার জন্য আমি সরি বললাম। এবং ট্যাক্সিকে প্রশ্ন করলাম, আমি যদি দরজাটা বন্ধ না করতাম তাহলে কী হতো? আমরা সেটার ব্যবস্থা করতাম, ট্যাক্সির স্পিকার আমাকে আশ্বস্ত করল। চালকবিহীন রোবট্যাক্সি পরিষেবাগুলি এখন জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু করা হয়েছে এবং সানফ্রানসিসকোর ব্যস্ত রাস্তায় সেগুলো চলাচল শুরু করেছে, যদিও বেশ সীমিত আকারে। ক্রুজ হচ্ছে মার্কিন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি জেনারেল মোটরসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ওয়েমো’র সাথে, যেটি গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেট-এর মালিকানাধীন। ক্রুজের রোবট্যাক্সিগুলো গত জুন মাস থেকে ভাড়া খাটতে শুরু করেছে এবং এর ভাড়া উবার বা লিফটের থেকে একটু কম।

দুটি কোম্পানির গাড়িতে চড়ে আমি সানফ্রানসিসকো শহরের এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করি। ট্যাক্সির সামনে চালকের আসন খালি। স্টিয়ারিং হুইল একা একা ঘুরতে থাকে। গাড়ির ক্যামেরা, লেজার রশ্মির লিডার সিস্টেম এবং রেডার থেকে পাওয়া ডেটা ব্যবহার করে গাড়িটি চালায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি। আমি যেসব রাইডে চড়েছি সেগুলি বেশিরভাগই মসৃণ এবং অটোনোমাস গাড়িগুলি রাস্তায় সাইকেল চালক এবং পথচারীদের বাঁচিয়ে সতর্কভাবেই চলাচল করেছে। তবে আমি নিজে ড্রাইভ করার সময় যে স্পিডে গাড়ি চালাই তার তুলনায় এই রোবট্যাক্সিগুলো বেশ সতর্ক বলে মনে হয়। তবে যাত্রাপথের কিছু অংশে ট্যাক্সিগুলো অযথাই রাস্তায় বেশি ঘোরাফেরা করেছে।

রোবট্যাক্সিগুলো যখন রাস্তায় থাকে তখন পথচারীরা তাদের দেখে থমকে দাঁড়ায় এবং হা করে তাকিয়ে থাকে। তারা ছবি তোলে এবং এই চমকপ্রদ প্রযুক্তির ট্যাক্সির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। আমি যতবার এই রাইড ব্যবহার করেছি, সে সময় বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ট্যাক্সিগুলো রাস্তার মধ্যখানে বিপজ্জনকভাবে হঠাৎ থেমে যাওয়ার কিছু ঘটনা সানফ্রানসিসকো কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে শহরটির কর্তৃপক্ষ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের যানবাহন নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে বলেছে, যতক্ষণ না তারা এসব সমস্যার সমাধান করবে, ততক্ষণ তারা যেন রোবট্যাক্সি কোম্পানিগুলোর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা অনুমোদন না করে। বর্তমানে রোবট্যক্সিগুলি শুধুমাত্র শহরের কিছু অংশে চলাচল এবং বিশেষভাবে ডাউন-টাউন অর্থাৎ শহরের কেন্দ্রস্থলে যায় না। এসব ট্যাক্সি কোম্পানি এখন চায় আরও বেশি এলাকা জুড়ে তাদের পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে এবং ট্যাক্সির সংখ্যা আরও বাড়াতে।

রোবট্যাক্সি এখন রাত ১০টা থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে চলাচল করে। কিন্তু ক্রুজ কোম্পানি এখন দিনের বেলাতেও তাদের পরিষেবা চালাতে আগ্রহী। অন্য একটি কোম্পানি ওয়েমোকে ২৪ ঘণ্টা শহরে ট্যাক্সি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং চালকবিহীন ট্যাক্সি ভাড়া খাটানোর জন্য কোম্পানিটি এখন সরকারি অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে।

এই মুহূর্তে ওয়েমো বা ক্রুজ ট্যাক্সির রাইডের জন্য ডাকতে মানুষকে ওয়েটিং লিস্টে নাম লেখাতে হচ্ছে। অন্যদিকে, রোবট্যাক্সি কোম্পানিগুলি তাদের নানা ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা বিনামূল্যে রাইড ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যান্য যেসব শহরে সীমিত আকারে এধরনের চালকবিহীন রাইড-হেইল সার্ভিস চালু হয়েছে সেগুলো হলো অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের শহর ফিনিক্স (ওয়েমো এবং ক্রুজ দুটি কোম্পানি এখানে কাজ করছে) এবং টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের শহর অস্টিন (ক্রুজ)। দুটি কোম্পানিই আরও অনেক শহরে ব্যবসা চালু করার পরিকল্পনা করছে। তবে এরা একা নয়। অন্যান্য কোম্পানিও এধরনের চালকবিহীন গাড়ি চালু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা হেইউন্দের সাপোর্ট নিয়ে কাজ করছে একটি কোম্পানি, নাম তার মোশনাল। রাইড হেইলিং কোম্পানি উবার এবং লিফটের সাথে এর অংশীদারিত্ব রয়েছে। এবছরেই লাস ভেগাসে তারা সীমিত আকারে এআই প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ট্যাক্সি চালুর পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু তারপরও মানুষের যাতায়াতের এই উদ্ভাবনীর অগ্রগতি বেশ ধীর। অটোনোমাস ট্যাক্সির ব্যবসা আসলে লাভজনক হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বল্প বেতনের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের খরচের খাতায় লিখে দিতে এসব কোম্পানি বহু অর্থ বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আমার ট্যাক্সির দরজা ঠিক মতো বন্ধ না করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি দেখায়, এসব ট্যাক্সির অপারেশনগুলি সম্পূর্ণভাবে মানব-মুক্ত করার লক্ষ্য এখনও অনেক দূরের ব্যাপার। তবে ক্রুজের একজন মুখপাত্র পরে আমাকে জানিয়েছেন যে, দরজাটি সামান্য বন্ধ থাকলেও পরে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরোপুরিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। তবে দরজাটি যদি অনেকখানি খোলা থাকতো তাহলে একজন মানুষকেই তা বন্ধ করতে হতো।

‘হালকাভাবে বললেও (অটোনোমাস ট্যাক্সির) অর্থনীতি এখনও কল্পনার ওপর ভর করে চলছে,’ বলছেন হার্ভার্ড ল স্কুলের গবেষক অ্যাশলি নুনেস। তিনি এসব ট্যাক্সির ব্যবসায়িক দিক নিয়ে গবেষণা করেন। রোবট্যাক্সির ব্যবসার সঠিক মডেলটি তৈরি করার কাজ বেশ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এবং এই মডেল তৈরি করা ‘প্রযুক্তির চেয়েও কঠিন,’ বলছেন ইউনিভার্সিটি অফ সানফ্রানসিসকো স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক উইলিয়াম রিগস।

গত এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অটোনোমাস ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রটিতে বার বার করে পরিবর্তন ঘটছে। আর এই পরিবর্তনের পেছনে ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ২০১০ সালেই কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আমরা এখনকার সময়ের মধ্যেই আমাদের বেশিরভাগ যাতায়াত অটোনোমাস গাড়িতেই করব। কিন্তু সেটা ঘটেনি। দুই গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ফোর্ড এবং ফোক্সভাগেন একটি সেলফ-ড্রাইভিং টেক স্টার্ট-আপ আরগো এআই-তে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি এখন বলছে, ব্যক্তিগত অটোনোমাস গাড়ি, যেখানে যাত্রীরা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই ব্যবহার করতে পারবেন, সেটা অনেক দূরের ব্যাপার। এর বদলে তারা এখন মনোযোগ দিচ্ছেন অত্যাধুনিক ড্রাইভার অ্যাসিসটেন্স প্রযুক্তির দিকে। অটোনোমাস শাটল সার্ভিস, যেগুলো নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করবে, সেই ধরনের সীমিত পরিষেবার দিকে ব্রিটেনের সরকারসহ অন্যান্যদের মনোযোগ এখন বাড়ছে।

কিন্তু ক্রুজ এবং ওয়েমো তাদের পরিকল্পনা থেকে একটুও সরে আসেনি। তারা আরও বেশি করে বিনিয়োগ করছে এবং ধীরে ধীরে অগ্রগতি অর্জন করছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। ফিনিক্স শহরে ক্রুজ রাইড-হেইল এবং ‘লাস্ট-মাইল’ অর্থাৎ ডেলিভারির শেষ ধাপে চালক-বিহীন গাড়ির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে মাল পৌঁছে দেয়ার ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ওয়েমো দূরপাল্লার রুটের জন্য অটোনোমাস ট্রাক তৈরি করছে।

অটোনোমাস ট্যাক্সির সুবিধাগুলিকে মানুষের কাছে অনেক বেশি নিরাপদ – যদিও এটি এখনও প্রমাণিত হয়নি, অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য এবং অনেক বেশি আরামদায়ক বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, যেখানে ড্রাইভারের সঙ্গে যাত্রীকে বকবক করতে হয় না। তবুও এসব সুফল পেতে হলে এই সার্ভিসকে আর্থিকভাবে টেকসই হতে হবে।নুনেসের বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে। কিন্তু তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে সমস্যাগুলি দূর করা যায়নি। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, অটোনোমাস রাইড-হেইলিং সম্পর্কে অনেক আশার কথা বলা হলেও একে ব্যবসায়িক দিক থেকে এখনো লাভজনক করা যায়নি। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পর্দার আড়ালে হলেও এই প্রযুক্তিতে এখনো মানুষের প্রয়োজন রয়েছে। অটোমেশনের ফলে যে শ্রম দরকার তার ধরনটি বদলে যায়, কিন্তু মানুষের শ্রমের প্রয়োজনীয়তা এটি দূর করতে পারে না।

পরিবহনবিষয়ক কনসালট্যান্ট নিক রিড বলেছেন, রোবট্যাক্সি সার্ভিসের জন্য প্রয়োজন হবে কাস্টমার সাপোর্ট এজেন্ট, গাড়ি কোথায় আছে তা জানার জন্য দরকার হবে ফ্লিট অপারেটরদের, এসব গাড়ির যান্ত্রিক সমস্যার সমাধানে লাগবে ইঞ্জিনিয়ারদের। এর পাশাপাশি বিকল গাড়িগুলিকে উদ্ধার করা, সেগুলোকে পরিষ্কার রাখা এবং এর ব্যাটারিগুলি চার্জ করার জন্যও লোকের প্রয়োজন হবে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, অনেক সময়েই ভাড়া না পেয়ে ট্যাক্সি খালি বসে থাকে। যদিও এর জন্য ড্রাইভারকে অর্থ দেয়ার বিষয়টা আর থাকবে না, কিন্তু অটোনোমাস ট্যাক্সি ব্যবসার পেছনে যেসব লোক কাজ করবেন তাদেরকে তখনও পয়সা দিতে হবে। তবে এসব কোম্পানি এখনও আত্মবিশ্বাসী যে, তারা ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পরবে এবং লাভজনক হতে পারবে। মেগান প্রিচার্ড, ক্রুজের রাইড-হেইল বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট জানাচ্ছেন, তারা ‘অরিজিন’ নামে নতুন ধরনের একটি গাড়ির ওপর কাজ করছেন। এই গাড়িটি একটি অটোনোমাস পিপল মুভার (মাইক্রোবাস) যাতে কোন স্টিয়ারিং হুইল বা চালকের জন্য জায়গা নেই। এই ট্যাক্সিতে যাত্রীদের জন্য সিট রয়েছে ছয়টি। অরিজিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে খুব শীগগির। ক্রুজ আশা করছে, এই বছরেই যুক্তরাষ্ট্রে রাইড-হেইলিংয়ের জন্য এই ট্যাক্সির ব্যবহার শুরু হবে, এবং এরপর দুবাই শহরে এসব ট্যাক্সি ভাড়া খাটা শুরু করবে।

ওয়েমোও একই ধরনের একটি গাড়ি তৈরি করছে, যার নাম ‘যিকর’।

ক্রুজের অরিজিন গাড়ি মিশিগানে জিএমের ডেডিকেটেড ইলেকট্রিক ভেহিকল অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে ব্যাপক সংখ্যায় নির্মিত হবে বলে এর উৎপাদন ব্যয় হবে ‘অনেক কম,’ বলছেন মিজ প্রিচার্ড। এই গাড়ি রাইড শেয়ারিংয়েরও সুযোগ খুলে দেবে। অর্থাৎ একই রুটে অনেক যাত্রী একই গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন। এর মাধ্যমে প্রতিটি গাড়ির সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে এবং যাত্রীদের মাথাপিছু ভাড়াও কমে যাবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এধরনের হাজার হাজার গাড়ি রাস্তায় নামানো হবে বলে মিজ প্রিচার্ড আশা করছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, তাদের কোম্পানি মানুষ ও অটোনোমাস গাড়ির অনুপাত কমিয়ে আনতেও কাজ করছে। তখন অরিজিনের দরজাগুলো দূর নিয়ন্ত্রিতভাবে বন্ধ করা যাবে। তবে এনিয়ে অন্যদের মনে এখনও সংশয় রয়ে গেছে, বলছেন নুনেস। তাদের যুক্তি, আগেও যাত্রীরা অপরিচিত লোকের সাথে ট্যাক্সি শেয়ার করতে চায়নি, এখন চায় না। কিন্তু রাইড শেয়ারিংয়ের দুনিয়ায় গাড়িতে এমন কি কেউ থাকবে যে যাত্রীদের মধ্যে কোন সমস্যা হলে সেটার সমাধান করবেন? ‘এখানে কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে, যার সমাধান খুঁজে বরে করতে হবে,’ মন্তব্য করলেন রিড।
তথ্যসূত্র : বিবিসি

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ