সাতক্ষীরায় বাগদা চিংড়ি ঘেরে মড়ক

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: দেশের অন্যতম চিংড়ি উৎপাদনকারী জেলা সাতক্ষীরা। গত বছরও এ জেলায় ২৪ হাজার ৪৫৭ টন রফতানিজাত বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। এ বছরও ২৪ হাজার ৫০০ টন চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা মৎস্য বিভাগ। তবে গেল কয়েক দিনের তীব্র দাবদাহে ঘেরগুলোতে মরতে শুরু করেছে মাছ। এতে শঙ্কায় রয়েছেন সাতক্ষীরার মাছচাষিরা।

গেল কয়েকদিন গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে গোটা জেলা। উপকূলীয় আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন ঘের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনাবৃষ্টি আর প্রখর রোদে মাছের ঘের আর ছোট-বড় জলাশয়গুলোতে কমে গেছে পানি। অত্যধিক তাপে এই অল্প পানি উত্তপ্ত হয়ে ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যাচ্ছে চিংড়ি পোনাসহ বিভিন্ন জাতের মাছ।

স্থানীয় মৎস্যচাষিরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর গ্রীষ্মে তাপমাত্রা অনেক বেশি। হয়নি কাঙ্খিত বৃষ্টি। ফলে লবণ পানির ঘেরগুলোতে লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে গত এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ঘেরে মাছে মড়ক লেগেছে। অনেকে নতুন করে আর চিংড়ি পোনা ছাড়ছেন না।

আশাশুনি দয়াঘাট এলাকার মাছচাষি সমির দাস জানান, প্রচন্ড গরম, তাপ আর পানিতে লবণাক্ততার কারণে তার ৩টি ঘেরের বাগদা চিংড়িসহ বেশকিছু মাছ মরে যাচ্ছে। অত্যধিক গরম এবং বৃষ্টি না হওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে এ অঞ্চলের প্রায় সব মৎস্য ঘেরের একই দশা।

তিনি বলেন, এখানকার পানিতে এখন লবণাক্ততার পিপিটি ১৮ এর ওপর (লবণাক্ততা পরিমাপের ব্যবস্থা)। এ অবস্থায় মাছ টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। এসব বিষয়ে মৎস্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা তাদের কাছে আসেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

একই এলাকার মাছচাষি তারক বিশ্বাস বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় চিংড়ি মাছের চাষ করছি। গত ২-৩ বছর ধরে গরম বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এবছর আরও বেশি।

তিনি বলেন, তার ঘেরসহ আশপাশের ঘেরে চিংড়িসহ বেশ কিছু মাছ মরে যাচ্ছে। ভয়ে ঘেরে নতুন করে চিংড়ির পোনা ছাড়ছেন না তারা।

আশাশুনি উপজেলার চিংড়িচাষি রাজেস্বর দাশ বলেন, তিনি চলতি মৌসুমে ২ হাজার বিঘা আয়াতনের ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করছেন। জমির লিজ মূল্য, রেণু পোনা ক্রয়, ঘের পরিচর্যা ও শ্রমিকের বেতন-ভাতা দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা কমেছে। দামও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তার ওপর এবার তীব্র দাবদাহের কারণে সঠিকভাবে মাছ ছাড়তে না পারায় উৎপাদনে ঘাটতি পড়বে।

বাংলাদেশ চিংড়ি রেণু পোনা উৎপাদন মালিক সমিতির সভাপতি ডা. আবুল কালাম বাবলা বলেন, সাতক্ষীরায় প্রতি মৌসুমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাগদা রেণু পোনা বেচাকেনা হয়। এসব পোনার ৯০ শতাংশই আসে কক্সবাজার থেকে। এছাড়া কিছু স্থানীয়ভাবে ও প্রাকৃতিক উপায়ে সরবরাহ হয়। তবে তীব্র দাবদাহের কারণে এবার চিংড়ি পোনার বেচাবিক্রি কমে গেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমায় এবছর চিংড়ির ন্যায্য দাম পাননি চাষিরা।

সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম চিংড়ি রফতানি ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা দিপা সি ফুডস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্তাধিকারী দীনোবন্ধু দাশ বলেন, করোনা সংকট কাটিয়ে চিংড়ি রফতানি প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো চিংড়ির চাহিদা কমায় দাম কমেছে। এতে ব্যবসায়ী ও চাষি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

মৎস্য বিভাগের তথ্য মতে, সাতক্ষীরা জেলায় মোট ঘেরের সংখ্যা ৬৫ হাজারেরও বেশি। চলতি বছর জেলার প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ৫৪ হাজার ৯৬০টি লবণ পানির ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ থেকেও দাবদাহ থেকে মাছ রক্ষায় চাষিদের সতর্ক করে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, সারা দেশে মোট যে পরিমাণ রফতানিজাত চিংড়ি উৎপাদন হয় তার ৬৫-৭০ শতাংশ যোগান দেয় সাতক্ষীরা জেলা। তবে চলতি বছর তীব্র দাবদাহের কারণে মাছের উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে কিছু এলাকায় ঘেরের মাছ মারা যাচ্ছে বলে চাষিরা আমাকে জানিয়েছেন। আমরা দাবদাহ থেকে মাছ রক্ষায় চাষিদের সতর্ক করে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করছি। তবে বৃষ্টি ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠার কোনো বিকল্প নেই।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ