গিয়াস কামাল চৌধুরী সাংবাদিক সমাজের অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন

প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট ও সংবাদ বিশ্লেষক গিয়াস কামাল চৌধুরীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত সাংবাদিক হিসেবে
তিনি সারা বাংলাদেশে গ্রামে-গঞ্জে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক সমাজের প্রিয়ভাজন নেতা ছিলেন। একাধিক বার তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজে,বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক হিসাবে লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গিয়াস কামাল চৌধুরী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ভুমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামেও তার ভুমিকা প্রশ্নাতীত। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিকতা শুরু করেন। কর্ম জীবনে অনেক সুযোগ-সুবিধা নেয়ার সুযোগ থাকলেও গিয়াস কামাল চৌধুরী নিজের জন্য কিছুই করেননি। বরং পেশার বাইরেও যেকোন সময়ে অনেক মানুষের বিপদে তিনিই ছিলেন অবলম্বন। গিয়াস কামাল চৌধুরী যেমন সাংবাদিক হিসেবে দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, তেমনি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের বিপদে বড় সহায় ছিলেন। একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, আগ্রাসন ও ঘৃণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনেও কঠোর ও আপসহীন ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতের বাইরেও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তার কাছে সমান মর্যাদায় সমাদৃত হতেন।
সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ২১ জুলাই ফেনীর শর্শদি চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন গিয়াস কামাল। ঢাকা টাইমস পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন তিনি। এর পর তিনি তৎকালীন মর্নিং নিউজে কাজ করেছেন । পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগদান করেন। বাসসে যোগদানের পর বাসসের কার্যক্রম দেশে ও বিদেশে সম্প্রসারিত হয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ভয়স অব আমেরিকায় তার বলিষ্ঠ প্রতিবেদনে প্রকম্পিত ছিল স্বৈরশাসকের ‘তখত-ই তাউস’। চোখে না দেখা গেলেও ভয়েস অব আমেরিকায় তার কণ্ঠে আন্দোলিত হতো এ দেশের শহর-বন্দর, হাট-ঘাট, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের চাওয়া পাওয়া। ‘গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভয়েজ অব আমেরিকা, ঢাকা’ বাক্য সারা দেশের মানুষের খবরের তৃষ্ণা মেটাত।
ছাত্রজীবন থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন তৎপর। পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতি, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, মৌলিক অধিকার, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে তিনি যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিক দলন ও সংবাদপত্র প্রকাশের বিরুদ্ধে সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
সাংবাদিক হিসেবে যেমন নিষ্ঠাবান ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, তেমনি দায়িত্ব পালন করেছেন দেশ ও জাতির জন্য। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধে তিনি সারা জীবন মানবতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন। সেবামূলক কাজের জন্য তিনি জীবনে বহু সম্মাননাসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত হন। গিয়াস কামাল ছিলেন এক জ্ঞানভাণ্ডার। জ্ঞানের যে কোনো শাখায় তার ছিল অবাধ পদচারণা।
গিয়াস কামাল ভাইয়ের সবচেয়ে বড়ো গুনছিল মাঠ
পর্যায়ে সাংবাদিকদের নাম মনে রাখতেন। মফস্বলের কোন সাংবাদিক সমস্যায় পড়লে তার কাছে গেলে সমাধান করার জন্য তিনি ছিলেন খুবই আন্তরিক।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়লে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিবিদ না হয়েও গণতন্ত্রের স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজী রেখে কাজ করেছেন। দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের জন্য, সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য অতুলনীয় অগ্রপথিক ছিলেন তিনি। বাম-ডান সব পন্থীদের জন্য গিয়াস কামাল চৌধুরী ছিলেন অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস। সত্যকে প্রকাশ করাই ছিল তার একমাত্র সাধনা।
৮০’ দশকের শেষের দিকে ভয়েজ অব আমেরিকা গিয়াস কামাল চৌধুরী কন্ঠ শুনেই তার ভক্ত হয়েছিলাম। আর তার পরন্তু বেলায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই গুনীজনের সান্নিধ্যে যাওয়ার। ২০০১ সালের বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজের নির্বাচনে গিয়াস কামাল ভাই সভাপতি ও মনজুরুল আলম ভাই ছিলেন মহাসচিব প্রার্থী। আমি ছিলাম গিয়াস কামাল ভাইয়ের একজন সমর্থক। ভোটের আগের দিন রাতে কিছু সংখ্যক সাংবাদিকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে গিয়াস ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে কর্মী সমর্থকদের বলেছিলেন এ নির্বাচন আমি দেখতে চাইনি। ঐ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে গিয়াস ভাই বিজয়ী হয়েছে ছিলেন। বহু বার তিনি যশোরে এসেছিলেন। সাংবাদিকদের রুটি রুজির আন্দোলনে কথা বলেছেন। যশোরের প্রতিথযশা সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল ও আর এম সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকান্ড নিয়ে বিচারের দাবিতে সাংবাদিক সমাবেশে তার বজ্রকন্ঠ আজও কানে বাজে।
এত বড়ো মাপের মানুষ হয়েও খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন যা তার স্মৃতিশক্তি ও স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।তিনি ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। আজ একটি সত্য কথা বলতে হয় গিয়াস কামাল চৌধুরীর তুলনা তিনিই। তাঁর মতো সাংবাদিক বান্ধব নেতা আর আমরা পাবো কি না জানিনা। আজ এই দিনে আল্লাহর কাছে আকুতি তুমি তোমার করুনা দিয়ে এই পরোপকারী সাংবাদিক সমাজের অহংকার গিয়াস কামাল ভাইকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।
লেখকঃ নূর ইসলাম
সাবেক সহকারী মহাসচিব
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ