রোগের নাম টিনিটাস: স্টিমারের পাল্লা অথবা ঝিঁঝির বাসা কানে

চিকিৎসক দেখিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কেউই রেহনুমা বেগমের কানের ভেতর স্টিমার চলার আওয়াজ বন্ধ করতে পারছেন না। রেহনুমা বেগম অনেক চেষ্টা করেন আওয়াজটাকে পাত্তা না দেওয়ার। দিনের বেলা হয়তো কোনোভাবে কাটান। কিন্তু রাতের নির্জনে ঘুমাতে গেলেই তিনি দুই কানের এই আওয়াজের কারণে প্রায়ই নির্ঘুম রাত পার করেন। মনে হয়, যেন কোনো সাগর পাড়ি দেওয়ার পাল্লা দিচ্ছে দুই কানের দুই স্টিমার। আস্তে আস্তে রেহনুমা বেগমের ঘুম কমে যাচ্ছে, বাড়ছে রক্তচাপ। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে ডায়াবেটিস।

আদিবার সামনে পরীক্ষা। রাতের ঘুম কমিয়ে পড়তে হচ্ছে। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম তো আছেই। সঙ্গে হালকা সর্দি লেগে নাকের একপাশ বন্ধ। আস্তে আস্তে সে খেয়াল করল, বন্ধ নাকের দিকের কানটায় কেমন যেন ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো আওয়াজ হয়। এমনিতে পড়ার সময় বা সারা দিন তেমন কিছু মনে হয় না। কিন্তু চারপাশ চুপচাপ করে যখন পড়তে বসে কিংবা ঘুমোতে যায়, তখন এই আওয়াজ আস্তে আস্তে তাকে অতিষ্ঠ করতে থাকে।

নাক-কান-গলার বিভিন্ন রোগের সঙ্গে বা আলাদাভাবে কানে ঝিঁঝি পোকার বা স্টিমারের মতো আওয়াজের এই সমস্যা অনেকেরই হতে পারে। এই বাড়তি যে আওয়াজ, একে বলা হয় টিনিটাস (Tinnitus)। ল্যাটিন যে শব্দ থেকে ইংরেজি শব্দটির উৎপত্তি ‘টিনিয়ার’, তার অর্থ হলো ঘণ্টার শব্দ। অনেকের কানে অনেক রকম শব্দ হতে পারে।

কানের কোনো রোগের কারণে যদি টিনিটাস হয়, তবে সেটা অল্প দিনের মধ্যে রোগী অনুভব করে। তবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ অনেক বছর ধরে যাদের কানে টিনিটাস আছে, তাদের শুধু কানের সংক্রমণ নয় বরং অন্য নানা রোগ থাকতে পারে।

আবার কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক নিজেও রোগীর কানে এ ধরনের আওয়াজ শুনতে পান। কানের ভেতর কিছু টিউমার বা রক্তনালির অতি বৃদ্ধির কারণে এ রকম হতে পারে। অনেক সময় কেবল কানে সামান্য ময়লা বা খৈল জমেও টিনিটাস হতে পারে। সে ক্ষেত্রে খৈল বের করে নিলেই টিনিটাস সেরে যায়।

কানের কিছু রোগ, উচ্চমাত্রার শব্দ, বাজি-পটকার আওয়াজ, হেডফোন ব্যবহারের কারণে যে টিনিটাস হয়, সেটা সাধারণত একটানা হয়ে থাকে। রক্তনালি বা অন্যান্য টিউমারের কারণে হওয়া টিনিটাসে একধরনের স্পন্দন থাকে। ধূমপান বা মদ্যপান, বড় করে হাই তোলা, জোরে শব্দ করে হাঁচি দেওয়া, জোরে নাক ঝাড়া ইত্যাদিতে টিনিটাস বাড়ে। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, স্ট্রোকের চিকিৎসার কিছু কিছু ওষুধ, নানা রকম অ্যান্টিবায়োটিক, যক্ষ্মার ওষুধ ইত্যাদির কারণেও টিনিটাস হতে পারে।

মূলত আমাদের যা মনে রাখতে হবে, তা হলো টিনিটাস কোনো রোগ নয়। এটা উপসর্গ মাত্র। একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে সময় নিয়ে কবে, কখন, কীভাবে শুরু হয়েছে থেকে শুরু করে, কী কী চিকিৎসা চলছে, দৈনন্দিন জীবনে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, সবকিছু খুলে বলতে হবে। এরপর চিকিৎসক রোগীর শরীরে আর কোনো উপসর্গ আছে কি না দেখবেন। টিনিটাসের কারণ সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষাও দিতে পারেন।

টিনিটাস কী কারণে হচ্ছে, তা নিরূপণের পর চিকিৎসা শুরু হবে। অনেক সময় এটা কেবল বিশ্রামেই সেরে যায়। অনেক সময় কিছু আগে থেকে খেয়ে আসা ওষুধ বন্ধ করে দিলেও সেরে যায়। খাওয়াদাওয়া ও স্বভাবগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, যেমন চা-কফি, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল, চকলেট ইত্যাদি এবং ধূমপান বন্ধ রাখা ভালো। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি, জিংক, ম্যাগনেসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে এর প্রতিরোধে। এ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে টিনিটাস হয়ে থাকলে সেটা বন্ধ রাখা, তার পরিবর্তে অন্য ওষুধ বাজারে থেকে থাকলে সেটা খাওয়া, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। এ ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শমতো টিনিটাস দূর করার ওষুধও খাওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

অনেকের কানে হিয়ারিং এইডের মতো টিনিটাস মাস্কার ব্যবহার করতে পারেন। সেটা ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলে ঘুমানোর কক্ষে টিকটিক শব্দ করে চলা দেয়ালঘড়ি অথবা মোবাইলে টিনিটাস মাস্কিং অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে।

অনেকের ক্ষেত্রে অন্ত কর্ণে বৈদ্যুতিক প্রবাহ, প্রশান্তিকারী ব্যায়াম, মেডিটেশন, কাউন্সেলিং, আকুপাংচার, সম্মোহন থেরাপি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। খুব অল্প ক্ষেত্রেই অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে।

বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসকের পরামর্শ, পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও উপযুক্ত চিকিৎসা পরিপূর্ণ আরোগ্য ও প্রশান্তিময় জীবন নিশ্চিত করে। তবে যে ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতিতেই আস্থা রাখুন না কেন, মনে রাখবেন, মনের জোরটাই হলো আসল।

লেখক: এমবিবিএস (ইউএসটিসি-১৮), বিসিএস (স্বাস্থ্য), ডিএলও ট্রেইনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১