ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করা আ. লীগের ছয় সম্মেলন

বগুড়া নিউজ ২৪ঃ আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকেই দলটির জাতীয় সম্মেলনগুলোর বেশ কতগুলোই ঐতিহাসিক গুরুত্ব পেয়েছে পরের ঘটনাপ্রবাহের কারণে। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে থাকা দলটি আন্দোলন, জটিলতাপূর্ণ সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে দলটির সিদ্ধান্তের কারণে পরে ইতিহাসই পাল্টে গেছে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আমলে। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ২০টি জাতীয় সম্মেলন করেছে। আর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে করেছে আরও সাতটি বিশেষ সম্মেলন।

দলটির ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশেষ সম্মেলনের সিদ্ধান্তে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতি পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৪ থেকে ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহের অলকা সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সম্মেলনটি। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ঠেকাতে সেই সময়ের আওয়ামী মুসলিম লীগ জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে এই বিশেষ সম্মেলন করে। সম্মেলনে সারাদেশ থেকে ৩০০ জন অংশ নেয়। কাউন্সিলরদের ভোটে জোট গঠনের প্রস্তাব পাস করা হয়।

এরপর ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলী সিলেটির বামপন্থি গণতন্ত্রী পার্টি।

১৯৫৪ সালের পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী ‍মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। আর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের রাজনীতি শেষ করে দিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের পথ সুগম করে এই জোট। ওই নির্বাচনের পরাজয়ের পর আর কখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অভিজাত মুসলিমদের সংগঠন মুসলিম লীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার দলটি বলতে গেলে এক অর্থে মৃত্যু হয় এই নির্বাচনের মাধ্যমে।

১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর রূপমহল সিনেমা হলে তৃতীয় সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয় দলের। দলের নাম থেকে একটি ধর্মের নাম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। এ সম্মেলনে প্রথমবারের মত ৫ জন নারীও অংশ নেন।

১৯৬৬ সালে ১৮ থেকে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির গতিপথ পরিবর্বতন হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবিত ৬ দফা প্রস্তাব দলীয় ফোরামে পাস হয়। যে ছয় দফার আন্দোলন পরে স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নেয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অন্যতম বড় মাইলফলক। ১৯৭০ সালের ৪ থেকে ৫ জুন অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দলীয় সিদ্ধান্ত হয় শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে হলেও জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে দল। সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। যদি নিয়মতান্ত্রিকতায় ব্যর্থ হয় তবে অনিয়মতান্ত্রিকতার পথ বেছে নেয়ার অধিকারও জনগণের আছে।’

এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী ফলাফলে বিস্মিত জেনারেল ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো শুরু থেকেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অপ্রত্যাশিত জটিলতা সৃষ্টি করেন ও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখেন৷

জেনারেল ইয়াহিয়া অজুহাত দেখান যে, আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন দাবি (ছয় দফা) পাকিস্তানে সাংবিধানিক সংকটের সূচনা করবে৷ নির্বাচনের রায় অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করে৷

১৯৮১ সালের ১৩ তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য এ সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আনা হয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকে। ৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট ছিল ৩ হাজার ৮৮৪ জন। সভায় শেখ হাসিনা সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে ১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক দলত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

দলের নেতৃত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ছয় বছর দেশে ফিরতে পারেননি শেখ হাসিনা। কিন্তু দলীয় সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সেই সময়ের জিয়াউর রহমানের সরকার আর বাঁধা দিতে পারেনি। এরপর ১৭ মে বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

১৯৯৫ সালে ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলটির ষষ্ঠ বিশেষ সম্মেলনটিও ভীষণ গুরুত্ববহ হয়ে উঠে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ওই সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়।

এরপর  আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলনে যায় এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির অধীনে নির্বাচন বর্জন করে। বিএনপি সে সময় এক তরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসলেও ১২ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে প্রবর্তন করে। এবং ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১