সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে কুমড়ো বড়ি তৈরীর ধুম

শাহজাদপুর প্রতিনিধিঃ  সারাদেশের মতোই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরেও হালকা শীতের আগমন ঘটেছে। আর শীত মানেই হাজার বছর ধরে চলে আসা রেওয়াজ বাঙালির ঘরে ঘরে চলে হরেক রকম খাবারের উৎসব। শীত মানেই ভোজন রসিকদের জন্য আলাদা আমেজ। এই শীতকে কেন্দ্র করে বৈচিত্র্যময় খাবারের তালিকায় আলাদা স্বাদ আর গন্ধ নিয়ে ভোজন রসিকদের রসনা তৃপ্ত করতে যুক্ত হয়েছে কুমড়ো বড়ি।

প্রতি বছর শীতের সময় গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িতে ‘কুমড়ো বড়ি’ তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। মাছ ঝোলে বা সবজির সঙ্গে কুমড়ো বড়ি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খাবার। এক সময় গ্রামের নারীরা নিজেদের পরিবারের জন্য কেবল অল্প পরিমান কুমড়ো বড়ি তৈরি করলেও এখন চিত্র পাল্টেছে। শীতের আগমনের সাথে সাথেই সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ঘরে ঘরে যেমন ‘কুমড়ো বড়ি’ তৈরির হিড়িক পড়েছে তেমনি উপজেলার অন্তত দুইশত নারী বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করছেন এই খাবার। সুস্বাদু এই খাবার শাহজাদপুর ছাড়িয়ে এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরে ভোজন রসিকদের তৃপ্তি দিচ্ছে।

এই কুমড়ো বড়ি বানিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল করেছেন অনেকেই। আর এই কুমড়ো বড়ি বানিয়ে নিজের ভাগ্য বদল একজন নারী সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গাড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের জাহানারা খাতুন। ৫০ বছর বয়সী এই নারী শীতের আগমনের সাথে সাথেই ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কুমড়ো বড়ি বানাতে। দুই দশক সময় ধরে দক্ষ হাতে কুমড়ো বড়ি বানিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করে বদল করেছেন নিজের ভাগ্য। এক সময় কেবল পরিবারে বাড়তি আয়ের জোগান দিতে এই খাবার বানানো শুরু করলেও এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভাবে তৈরি করছেন তিনি।

সরেজমিন কথা হয় জাহানারা খাতুনের সাথে। তিনি জানান, ২০-২৫ বছর ধরে এই কুমড়ো বড়ি বানাচ্ছি। মাসকলাইয়ের ডাল আর চাল কুমড়ার মিশ্রণ রোদে শুকিয়ে তৈরি করতে হয় কুমড়ো বড়ি। এই বড়ি দিয়ে কৈ, শিং বা শোল মাছের ঝোল বেশ জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু। আর কুমড়ো বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময় হলো শীতকাল। তাইতো শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে কুমড়ো বড়ি তৈরির ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আমার মত এখন এলাকার শত শত নারী কুমড়ো বড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছে।

এই এলাকার আরেকজন কুমড়ো বড়ি ব্যবসায়ী মনোয়ারা জানান, আশ্বিন মাস থেকে ফালগুন এই ছয় মাস কুমড়ো বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা বাজারে বিক্রি করা হয়। শীতের সময় ব্যাপক চাহিদা থাকায় গ্রামাঞ্চলের নারীরা বাড়তি আয়ের জন্য কুমড়ো বড়ি তৈরি করেছেন।

উপজেলার গাঁড়াদহ ইউনিয়নের তালগাছি গ্রামের মুনজুরুল বলেন- এক কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে ৭০ থেকে ৭৫ টাকার মতো খরচ হয়। আমরা সেই কুমড়ো বড়ি পাইকারি বিক্রি করি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেগুলো আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।

উপজেলার কুমড়ো বড়ির ব্যবসায়ী নির্মল সরকার বলেন- এখানকার কুমড়ো বড়ি সুস্বাদু হওয়ায় এই অঞ্চলের কুমড়ো বড়ি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পাঠানো হয়। বিশেষ করে ঢাকা, পাবনা ও রাজশাহীতে এখানকার কুমড়ো বড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এদিকে সরেজমিন ঘুরে এলাকার কুমড়ো বড়ির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে কুমড়ো বড়ি বানাতে অনেক কষ্ট হতো। প্রথমে মাসকলাই দীর্ঘ সময় পানিতে ভিজিয়ে রেখে চাল কুমড়ো দিয়ে পাটায় পিষে সেটা মিশ্রণ করে রোদে শুকিয়ে তৈরি হত কুমড়ো বড়ি। এখন আর আগের মত কষ্ট হয়না। মাসকলাই মেশিন দিয়ে গুড়ো করে চাল কুমড়ো মিশিয়ে রোদে শুকিয়ে তৈরী হয় কুমড়ো বড়ি। এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করার প্রধান উপকরণ মাসকলাইয়ের ডাল, পাঁকা চাল কুমড়া আর সামান্য মসলা। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি মাসকলাই ১০০ থেকে ১২০ টাকা আর চাল কুমড়া ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কেনা হয়। পাঁচ কেজি চাল কুমড়ার সঙ্গে দুই কেজি মাসকলাইয়ের ডাউল মিশিয়ে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি। এরপর রৌদ্রোজ্জ্বল ফাঁকা স্থান, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ বা খোলা জায়গায় ভোর থেকে বড়ি তৈরি করা শুরু হয়। পাতলা কাপড় বা টিনের উপর সারি সারি বড়ি রোদে রাখা হয় শুকানোর জন্য। কুমড়ো বড়ি বানানোর পর দুই থেকে তিন দিন টানা রোদে শুকাতে হয়। সূর্যের আলো কম হলে তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত লাগে।

স্থানীয়রা জানান- জাহানারা খাতুন এক সময় খুব দরিদ্র ছিল। প্রথম দিকে অল্প পরিসরে পরিবারের বাড়তি আয়ের জন্য এই কুমড়ো বড়ি তৈরি করা শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভাবে কুমড়ো বড়ি বানানো শুরু করে। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাগ্য বদল ঘটেছে এই করেই। দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পাঠাচ্ছে। জাহানারা খাতুনের এই পরিবর্তন দেখে এলাকার দুই শতাধিক নারী এই কুমড়ো বড়ি বানানো শুরু করেছে। তাদের তৈরি কুমড়ো বড়ি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভোজন রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ